Wednesday 6 March 2013

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আমিও চাই, তবে... (১)


 ১
প্রাইভেট ভার্সিটি থেকে পাশ করা মৌরি নাজনিন কলা খায় না, বাঙ্গি খায় না, বড়ই খায় না, পেয়ারা খায় না, চা খায় না। তার প্রিয় ফল স্ট্রবেরী, প্রিয় পানীয় কফি। স্ট্রবেরীর স্বাদ ভালো না, টক টক লাগে এহেন কথা বলা হলে তিনি ষাঁড়ের মতো তেড়ে আসেন মারতে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেন ছাড়বে অথচ তিনি কমলাপুর এসে বসে থাকেন, উপায়ন্তর না দেখে অবিবাহিত রেল কর্মকতাকে সাত সকালে ফোন করে ট্রেন ১০ মিনিট থামিয়ে রাখার অনুরোধ করেন। তিনি সাড়ে ৪০ কেজি কসমেটিক্স নিয়ে ঢাকা থেকে নরসিংদী গিয়েছেন বন্ধুর বিয়েতে।

দিগন্ত বাহার তরুন সমাজের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
, যুক্তিবাদী ও সুদর্শন পুরুষ। আমাকে একবার অনুরোধ করিলেন তার মাথা ম্যাসাজ করে দিতে। আমি সাত- পাঁচ না ভেবে মাথা ম্যাসাজ করে দিলাম। কোন মানুষের চুলে এত দুর্গন্ধ হয়ে পারে আমার কল্পনায় ছিল না
কস্কো সাবান, হ্যান্ড সোপ দিয়ে হাত ডললাম কয়েকবার। ফলাফল শুন্য।

জাকিয়া সুলতানা আমার ফুপি। ১১ বছর প্রেম করে সফলতার সাথে বিবাহ করেছেন প্রেমিককে। যেখানেই যাওয়া হোক তার ছোট টয়লেট পায়
, ঝিনাইদাহ এর বাওড়ে নৌকা ভ্রমণে উঠে তার প্রথম বাক্য- আমার খুব চেপেছে। তিনি চিংড়ি মাছ ভেবে মাওয়া ফেরীতে আরশোলা চিবিয়ে খান, তার কোন ভাবান্তর হয়না।

আশিক ভাই পেশায় ইঞ্জিনিয়ার এবং সম্পর্কে আমার ফুপা বনেছেন। আমার অবিবাহিত ফুপিকে তথা তার অবিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় বেল্লেলাপনা করেছেন। হলুদের মঞ্চে বসে বাসর রাতে বউকে শোনাবার জন্য কবিতা মুখস্থ করেছেন। হবু বউয়ের বিয়ের শাড়ি বালিশের নীচে রেখে ঘুমিয়েছেন।

আমিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই
, কিন্তু ফাঁশি হলেই কি মৌরি নাজনিন প্রাইভেট ভার্সিটি ইগো ছেড়ে কলা,পেয়রা, বড়ই খাওয়া শুরু করবেন? দিগন্ত বাহার গোসল তথা চুলে এক আধটু শ্যাম্পু দেবেন? জাকিয়া ফুপির ছোট টয়লেট পাওয়া বন্ধ হবে? আশিক ভাইর অবিবাহিত স্ত্রী নিয়ে নির্লজ্জতা করা বন্ধ হবে?


 


সাজ্জাদ ভাই বারডেমের ইন্টার্ন। তিনি ডিউটি তো করেনই না
, বরং ছাত্র লীগের সহ সভাপতির রুমে বসে লাড্ডুতে কামড় দিতে দিতে প্রফেসরকে ফোন করে জানান সকল রোগির অবস্থা ভালো। তিনি দায়িত্ব নিয়ে ডিউটি দিচ্ছেন।
জন্মদিনের সন্ধ্যায় আমি ছোট ভাই হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার টাকায় চা- সিগারেট- ডালপুরি খেতে খেতে বলেন- হামীম ডাক্তারি করা অনেক কঠিন।

আলী ইমরান ভাই পেশীশক্তি তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে হলের খাবার রুমে আনিয়ে খান, দোকান থেকে লাড্ডু, মিষ্টি, কোলা, দধি মিষ্টি বাকিতে আনিয়ে খাওয়ান। আর আমাকে বলেন- হামীম, আজ যদি স্মুথ না হয়েছে তোরে আমি খাইছি।

জাহিদ ভাই বিমানবাহিনীর সোর্ড পাওয়া ক্যাডেট
, প্রচণ্ড অলসতার কারণে এখন স্কলাস্টিকায় মাস্টারি করেন। পুঁজিবাদে পচে যাওয়া এই মাস্টার আগামী দুই বছরের মাথায় এপার্টমেন্ট কেনার প্লান করেছেন। এত টাকা কোথা থেকে আসে?

রায়হান আবীর একটি কালো মুক্তা। তিনি ম্যাচের পর ম্যাচ ফুটবল খেলায় হেরে ল্যাপ্টপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলেন
কিভাবে পারো?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর হলের পাশের রাস্তা আবর্জনায় উপচে পরছে, পেশাবের গন্ধে শ্বাস নেয়া দায়। রায়হান আবির বলেন- হামীম এত পরিষ্কার রাস্তা ময়লা করতে অনেক খারাপ লাগছে, বিড়ির খালি প্যাকেটটা পকেটে রেখে দে, রাস্তায় ফেলিস না।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমিও চাই
, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেই কি সাজ্জাদ ভাই ঠিক ঠাক মতন ডিউটি করবেন? আলি ইমরান ভাই রাজনৈতিক শক্তির অপব্যবহার বন্ধ করবেন? জাহিদ ভাইয়ের কালো টাকার উৎস বের হবে? রায়হান আবির ভাই সজ্ঞানে ফিরে আসবেন?


মাহমুদুল হাসান রাব্বী, মেধাবী ছাত্র। তার বিশাল বপু দেখলেই আমার গরম লাগা শুরু হয়, কুকুরী বাচ্চা দেবার পর হাটার সময় তার ওলানগুলো যেমন পেন্ডুলামের মতো এদিক অইদিক ঝোলে রাব্বির ভুড়িও সেই রকম ঝোলে। বিশাল সঙ্খক লাইক পাবার পর শোনা যায় ছবির মেয়েটি তার সাথে প্রেম করতে রাজি হয়নি। প্রেমে ব্যর্থ রাব্বী এখন মডেল বিয়ে প্লাস কস্টিং করার ধান্ধায় দিন কাটায়।

আবির মজুমদার
, মুক্তিযোদ্ধা পুত্র। অতি সুদর্শন পুরুষ বিশেষ। সে জার্মানী গিয়ে জনৈক মেয়ের সাথে বিশাল ফষ্টি নস্টি করে এসেছে। সেই মেয়ের ড্রাইভারের কাছে আবির মজুমদারকে একটি প্যাকেট গছিয়ে দিতে দেখা যায়, আবির বলে উহা গ্রিন টি, আমার বিশ্বাস উহা জার্মানীতে চুরি করা রমনীর ব্রা ও প্যান্টি। ক্যারিয়ার গড়তে চাওএই ধরনের লোভ দেখিয়ে মেয়েদের শরীর হাতানোর স্বভাব তার দীর্ঘদিনের।

খায়রুল আনাম শিহাব ওরফে ব্যাটম্যান। ক্ষীণকায় এই পুরুষ একজন নারীলিপ্সু প্রকৌশলী। আশে পাশের সকল মেয়েদের দিকে শ্যনদৃষ্টি পাতের জন্য সে বহুল সমালোচিত। সারা শরীরে মাসল নেই
, কিন্তু তার ডান হাতের বাইসেপ ফুলে ওঠার কারণ কাউকে আর বুঝিয়ে দিতে হয় না।

আসিফ আল হাই
, বুয়েট ইইই এর মেধাবী ছাত্র ও দীর্ঘকায়। বুয়েট বিপ্লবের পর হতাশাগ্রস্ত এই তরুন এই এখন আসল কচি ডাব খাবার খাবার টিপস বিলিয়ে বেড়ায় ফেসবুকে। কাজাকিস্তান থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত মেয়ে পটানোর ধান্ধা করে বেড়ায়।

আশিকুর রহমান সামি, ফটোগ্রাফার ওরফে লুল। লম্বা মেশিন নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে মেয়েদের মুখের খোমা তুলে বেড়ানোই যার একমাত্র কাজ। ফেসবুক লিস্টের মেয়েদের সহসাই দেখা যায় সামির প্রোফাইলের ছবিতে, উপরে চিকা- রাইটস রিজার্ভড বাই আশিকুর রহমান সামি।

কাকের চেয়ে কবি দেশে অনেক বেশি থাকলেও, কাকের মতো কালো কবি একটিই। তিনি রিয়াজ হক তন্ময়। সদা হাসিখুশি এই কবি জনৈক মেয়েকে ইনবক্সে চল্কেট দিয়ে গোসল করাতে চাওয়ার কারণে বিখ্যাত। মিস ফরিদপুর খ্যাত সাবা রহমানের সাথে মন দেওয়া নেওয়ার পর কবি আমাদের সবাইকে ভুলে গেছেন, আমরা বলতে চাই – চল্কেট দিয়ে গোসল করানো এখনও হয়নি শেষ, ফিরে আসো আমাদের মাঝে তুমি কবি।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমিও চাই কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেই কি রাব্বির কস্টিং এর হিসাব করা বন্ধ হবে? আবিরের ব্রা প্যান্টি চুরি করা বন্ধ হবে? আসিফ আবার বিপ্লবী হবে? সামির ক্যামেরায় উঠে আসবে পতাকা, পাখি, ফুল? ইনবক্সে বন্ধ হবে কালো কবি তন্ময়ের চকলেটে গোসল করাবার আহবান?




বলাকা সিনেমা হলের দোতালায় দাঁড়িয়ে এক রমণী বলেছিল – আমার চোখের দিকে তাকান আমি ট্যারা না। ট্যারা কিনা লক্ষ করা হয়নি, তবে চোখ ছিল তার মায়াবতী।

বলেছিল কেউ –তুমি দিনকে দিন বখাটে হয়ে যাচ্ছ, বলব না আমি কথা বখাটে ছেলের সাথে।
কেউ বা বলেছিল- আমার সাথে দেখা করে কি হবে? আমি তো রাবারের মতো পায়জামা( লেগিংস) পরি না, যারা পরে তাদের সাথে গিয়ে দেখা করেন।

হিজাবী কোন মেয়ের সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছা ছিল বহুদিনের, প্রেমা আপুর গেট টুগেদারে হয়েই গেল পরিচিতি পর্ব, খুব এক্সপ্রেশন দিয়ে বলছি তখন কথা, বিশ্লেষণ করছি মানব দেহের একমাত্র নিউক্লিয়াস বিহীন কোষের কথা, প্রেমা আপু হুট করে এসে বললেন- এই হারামজাদা তুই কি ওর সাথে টাঙ্কি মারার চেষ্টা করছিস। আমার ইজ্জত আর শত ছিদ্রর কনডমের মাঝে কোন পার্থক্য রইল না।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমিও চাই, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেই কি কোন রূপবতী লক্ষ্মী ট্যারা হয়ে যাবে? আমাকে বখাটে বলা বন্ধ হবে? রাবারের মতো পায়জামা পরা চালু হবে? প্রেমা আপুর হাতে আমার ইজ্জতের ডিসমিস হওয়া বন্ধ হবে?




মাহবুবুর রহমান অমি রাজনীতির বলির শিকার হয়ে এখন মেসে থাকে। আমতলী এলাকার লীগ হাতে থাকা সত্ত্বেও হলে পোষাতে পারছে না। সে বাসায় এসে ঘুম থেকে আমাকে তুলে বলল – তোর শাদা হাফ প্যান্টটা দে, কুয়াকাটা যাবো। দিয়ে দিলাম আর ফেরত পাইনি কোনদিন।

সন্দিপ্তা সাদিক, প্রানে ভরা একটি প্রান। সারাক্ষন হুটোপুটি চিৎকার চেঁচামেচি। তাকে তার লাভার কাম বস একটি সনি এক্সপেরিয়া সেল ফোন গিফট করেছে, সে এখন সবাইকে এই কথা বলে বেড়িয়ে জেলাস করে তুলছে সবাইকে।

রাইসা হোসেন অসম্ভব রূপবতী হলেও বা কি, আকামের আট্টা, সামান্য সালাদ কাটতে পারে না। তার প্রতি ধিক্কার।

নাভেদ ফেরদৌস এখন থেকেই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, বিসিএস পাশ করলে নাকি তার লোক প্রশাসন পড়ুয়া আজন্ম প্রেম তাকে বিয়ে করার জন্য বাসায় ফাইট দেবে। সে নিয়মিত ক্রিকেট খেলায় শুন্য করে ডিপার্টমেন্ট এর চোখের বালি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচার আমিও চাই, কিন্তু যুদ্ধাপরাধীর বিচার হলেই কি অমি আমার হাফ প্যান্ট ফেরত দিয়ে যাবে? সন্দিপ্তা তার এক্সপেরিয়া আমকে দিয়ে দেবে? রাইসা সালাদ কাটা শিখে যাবে? নাভেল সেঞ্চুরি করবে?

( চলবে)

Tuesday 5 February 2013

ঋণ শোধের প্রহর


একটা সময় ছিল যখন মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকে গল্প শুনতাম তৃষ্ণা ভরা বুক নিয়ে, পাঠ্য বইয়ের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস পড়তাম জানার জন্য, অবজেক্টিভ প্রশ্ন উত্তর করার জন্য নয়।
জেনেছি, বুঝেছি, শুনেছি। মনে মনে কত ভেবেছি যদি আরেকবার এমন একটা অবস্থায় এসে বাংলাদেশ দাঁড়ায় তবে বুক চিতিয়ে লড়াই করবো।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়টা ছিল গৌরবের আর স্বাধীনতার অপেক্ষায় প্রহর গুনবার। সেই গৌরব আর স্বাধীনতা আমাদের মাটিতে এসেছে, আমরা ভোগ করেছি এবং করছি।
তবে সেই মুক্তিযুদ্ধের কান্না আর কষ্টের গল্পগুলো শুনতে ও অনুভব করতে আমাদের বরাবরই অস্বস্তি। আমরা নির্বিকার হয়ে পাঁচ বছর দেখেছি ধর্ষক আর খুনি রাজাকারেরা জাতীয় পতাকা খচিত গাড়ি নিয়ে আমাদের সামনে দিয়ে হুট করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। জাতীয় সংসদে ভাষণ দিচ্ছে।
আমাদের গায়ে হয়ত লেগেছে, লেগেছে বলেই দাবী এসেছে যুদ্ধাপরাধী বিচারের। বিচার শুরুও হয়েছে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছিলাম, দিন গুনছিলাম বাংলাদেশের রক্তের ঋণ শোধ করবার।
রাজাকার কাদের মোল্লার বিচারের রায় জাতির জন্য বড় একটি ধাক্কা। এই ধাক্কা কতজন সহ্য করতে পেরেছেন জানিনা। আমি পারিনি। আমি গিয়েছিলাম শাহবাগে প্রতিবাদ করতে। মনের কোন এক কোনে এখনও বিশ্বাস করি রাষ্ট্র আমাদের। আমরাই রাষ্ট্রের কাঁচামাল।
এই প্রতিবাদ স্বতঃস্ফূর্ত, এই প্রতিবাদ আপনার আমার সকলের। আপনি যদি মনে করেন ফেসবুকে কাভার ফটো আপলোড করে, শাহবাগের ছবি শেয়ার করেই আপনার দায়িত্ব শেষ তবে আপনার প্রতি আমি শ্রদ্ধা হারাচ্ছি। অন্যায় যে সহে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে যার জিহবা জড়, আমার কাছে সে জীবিত থেকেও মৃত। এই রাষ্ট্রের খেয়ে পরে যদি রাষ্ট্র নিয়ে আপনার মাথা ব্যথা না থাকে তবে আপনার উচিত বড় একটি সিরিঞ্জ কিনে আনা এবং নিজের শিরায় বিশাল একটি বায়ুর বুদবুদ ঢুকিয়ে মৃত্যুবরণ করা। কারণ আপনার মতো আকাঠ- অপ্রয়োজনীয় আগাছার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের কিছুই আসে যায় না।
জীবনে বাঁচতে শেখা একটি বড় শিক্ষা। এই বাঁচা যেন পরগাছা হয়ে বাঁচা না হয়। আপনি তরুন, পড়াশোনা করছেন, তাই বলে আপনার জগত পড়াশোনায় সীমাবদ্ধ যদি হয়ে থাকে তবে আপনি কোন শিক্ষার্থীর মাঝেই পরছেন না। আপনার চেতনায় যদি রাষ্ট্র না থাকে, যদি আপনার ধ্যান ধারণার বারান্দায়ও আপনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গৌরবকে জায়গা না দিতে পারেন তবে বলা চলে আপনার শিক্ষা বৃথা। আপনার সনদ পত্রগুলো পুড়িয়ে শেখ সিগারেট ধরাতেও আমার আপত্তি থাকবে না।
মুক্তিযুদ্ধ রাজনীতি নয়, কোন রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত সম্পত্তিও নয়। মুক্তিযুদ্ধ আপনার আমার সবার। খুঁজে দেখুন আপনার পরিবারেও হয়ত রয়েছে কোন মুক্তিযোদ্ধা, যিনি রাজনীতি অথবা জানের পরোয়া না করেই যুদ্ধে গিয়েছেন। তারা যদি দেশকে স্বাধীন করে আনতে পারেন রনক্ষেত্রে যুদ্ধ করে আপনার পারা উচিত তাদের রক্তের মর্‍্যাদা আর চেতনা সমুন্নত রাখা।
আপনি প্রেমিক- প্রেমিকাময় আপনার জগত, প্রেমিকার আঁচল রিক্সার চাকায় আটকে গেল কিনা সেই চিন্তায় আপনার কপালের চামড়া কুচকেই থাকে সর্বক্ষন। প্রেমিকা মন খারাপ করে না খেলে আপনিও খেতে পারেন না।
অথচ কারো না কারো প্রেমিকা, স্ত্রী, বোনকে ধর্ষন করেছে পাকি সেনাবাহিনী, ধর্ষনের পর কেটে রেখেছে অঙ্গ প্রত্যঙ্গ। রাজাকারেরা ধরে নিয়ে জমা দিয়েছে ক্যাম্পে, তারাও করেছে নির্বিচারে ধর্ষন। সেই ভারি আর্তনাদ আপনাকে কেন একবারও নাড়ায় না? কেন আপনি জাতির এই বীভৎস ইতিহাসকে ভালগার, হরর বলে না পড়ে গুটিয়ে রাখতে চান? কেমন প্রেমিক আপনি? কেমন সন্তান আপনি? কেমন ভাই আপনি?
মুক্তিযোদ্ধা রুমি শক্ত রুটির উপর থেকে পোকা খুটে ফেলে সেই রুটি চিবিয়ে খেয়ে যুদ্ধ করেছে, শহীদ রুমিদের কথা আপনার কি কখনই মনে হয় না? 
আপনি কিভাবে পারেন স্টেডিয়ামে গালে কপালে পাকিস্তানের পতাকা একে উল্লাস করতে? আমি আপনার সামনে আপনার ধর্ষিতা বোনের অন্তর্বাস নিয়ে উল্লাস করলে আপনার কেমন লাগবে? একটুকুও খারাপ লাগবে না?
যদি না লাগে, তবে আপনার চামড়া আমার কাছে অর্থহীন। আপনার গালের চামড়ায় বানানো স্যান্ডেল পরে টয়লেটে যেতেও আমার আপত্তি আছে।
মানুষ হিসেবে আপনার মাথা উঁচু করে বাচার দরকার, নীচু করে নয়। আপনার কথা আপনি বলবেন, সবার সামনে বলবেন। আপনিও আসবেন সবার সাথে সবার মাঝে, সবাইকে নিয়ে, আপনাকে দেখে আমরা আন্দোলিত হব, আপনার উপস্থিতি আমাদের জাগাবে প্রেরণা।
আজকের শাহবাগের আন্দোলন একটি নতুন ইতিহাস, শাহবাগ কোন রাস্তার মোড় নয়, বরং শাহবাগ এখন জনগণের প্রতিরোধের মুক্তমঞ্চ।
মশাল হাতে আপনি যখন রাজপথে স্লোগান দিচ্ছেন, আপনি তখন কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন না, দিচ্ছেন আপনার মন থেকে, আপনার চেতনাকে সমুজ্জ্বল রাখতে। আপনি সতীর্থ হচ্ছেন আপনার মতো আরও অনেকের সাথে।
আগুন হাতে আপনি আর ঘরের সোফায় বসে খবর দেখে হাই তোলা আপনির মধ্যে হাজার হাজার মাইল তফাৎ। মিছিলের আপনিই প্রতিবাদী আপনি, সেই আপনির কারনেই মুক্তিযোদ্ধারা কান্না ভেজা গলায় মাইকে বলে ফেলে ” এই তরুন সমাজের জন্য আরেকবার জীবন হাতে নিতে আপত্তি নেই”
তখন আপনার কি মনে হয় না সেই মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ কানাকড়ি হলেও আপনি শোধ করতে পারছেন?

Friday 19 October 2012

বিরিশিরি ডায়েরি (১)


ধারণা করেছিলাম বিরিশিরি হবে একটি ছবির মতো সুন্দর শহর, যেখানে ইংরেজি ছবির মতো টুরিস্টরা মাথায় ক্যাপ আর গায়ে হাওয়াই জামা পরে ছবি তুলবে, ঘুরে বেড়াবে ইত্যাদি।
অথচ বিরিশিরি ছবির চেয়েও সুন্দর, বাঁধানো ছবির মতো সুন্দর, তবে সেখানের বাজার নয়, প্রকৃতি, মানুষ, নদী আর পাহাড়।

বিরিশিরি বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় অবস্থিত একটি ইউনিয়ন, বিরিশিরি দূর্গাপুর উপজেলার অন্তর্গত। ময়মনসিংহ, ভালুকা , ত্রিশাল এরপর নেত্রকোনা পার হয়ে যেতে হবে বিরিশিরি।

প্রথম দিন-
১৫ অক্টোবর

সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য হলাম অমির ফোনের কারণে, আমার বিরিশিরি যাবার পেছনে এই অমির অনেকখানি ভূমিকা, অমি আমাদের বাড়ির একদম কাছের ছেলে, সে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা সহ রাজনীতি করে। যারা রাজনীতি করে না এবং বোঝে না আমার কাছে তাদেরকে “ছ” বিহীন ছাত্র মনে হয়।
অমির সাথে আমার সখ্যতা অনেক ছোটবেলা থেকে, ক্লাস ৬ থেকে। আমরা বরিশালের এক হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতাম, স্বমেহন করার পর আমি অমির জামা, গেঞ্জি দিয়ে হাত মুছতাম, অমি সেই কথাগুলো এখনও ভোলেনি, তবে বড় হয়েছে তাই এখন এগুলো নিয়ে ফান করে। এরপর আমি ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়ে যাওয়াতে আমাদের সম্পর্কে মৃদু ছেদ পরে।
অমির বাবা আওয়ামীলিগের বড় নেতা, তিনি লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কনট্রাক্টর হিসাবে কাজ করেন, আর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় থাকলে খেয়া ঘাঁটের নিজের ফার্মেসীর দোকানে বসে মাছি মারেন।

আমি আর আমি আজিমপুর মোড় থেকে রওনা হলাম ধানমন্ডি ৫ এর দিকে। সেখান থেকে এক বড়লোক পুত্রের গাড়িতে আমরা মহাখালী যাবো।

বড়লোক পুত্রের নাম নাভেদ। সে অতি সুদর্শন এবং  নম্র ভদ্র।




মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছেই আমরা টিকেট করে ফেললাম, ২৩০ টাকা করে টিকেট, আমাদের সাথে বাকি একজন উঠবে গাজিপুরা থেকে। বাসের নাম নিশিতা

“ সকালে খাও রাজার মতো
দুপুরে খাও পরিমিত
রাতের খাবার শত্রুকে দিয়ে দাও”
এই তত্ত্বকে সামনে রেখে আমি ৪টা আটার রুটি, ডাল+ভাজি, ৩ টা ডিম, কলা এবং সবশেষে এক বোতল লাবাং দিয়ে নাশতা সারলাম।
আমার খাওয়ার বহর দেখে যার পর নাই বিশালবপু নাভেদ খুব পুলকিত হোল। তবে আমার সম্পর্কে অমির ভালো ধারণা আছে বলে সে মুখ টিপে হাসলো শুধু।

বাসের সামনে একটা টিভির ব্যবস্থা আছে, সেখানে চলছে ভারতীয় বাঙলা ছবি, সব্যসাচী বড়লোক বাবার ভূমিকায় অভিনয় করছেন, তার ছেলে কিছুই পারে না ( আবাল বিশেষ) তবে সে খুব মনযোগ দিয়ে এক বড়লোকের মেয়ের সাথে প্রেম করে, এবং ন্যাকা ন্যাকা ডায়লোগ দেয়, শেষমেষ তার প্রেমতীর ছুটে যায় দীর্ঘ বসনা, মধ্যবিত্ত এক কলেজ ললনার দিকে, আর এরপর সেই মেয়ে ধীরে ধীরে জয় করে নেয় বাড়ির সবার মন ইত্যাদি ইত্যাদি।
বাঙলা এবং হিন্দী ছবিতে সবসময়েই ঘরমুখো, দীর্ঘবসনা, পতি ও পতি পরিবার ভক্ত নায়িকার জয় হয়। আরেকবার আমার অনুসিধান্ত সত্য বলে প্রমানিত হল।

ছবিতে নায়িকা যখন পতি পরিবারের মন জয় করার চেষ্টা করছে তখন আমি ঘুমে হারিয়ে যাই। মাঝে একবার উঠে এক বোতল পানি আর একটা আমড়া খেয়ে আবার ঘুম।
ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন আমরা ত্রিশাল। ত্রিশাল কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিজড়িত শহর, এছাড়াও আমার আর কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন একই, তাই ত্রিশালে ঘুম চলে না।
ত্রিশাল পার হবার সময়ে টিভিতে চলছে থ্রিলার+একশন+রোমান্স ধর্মী ছবি। নায়ককে কলকাতা পুলিশের এক অফিসার হত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে, নায়ক কোন এক জায়গা থেকে এক নায়িকা জুটিয়ে নিয়েছে, এখন তারা দুজনেই ফেরারী।

এরমধ্যে আমাদের সাথে চলে এসেছে নেওয়াজ, সে এক্স ক্যাডেট। সেই গাজিপুরা থেকে উঠেছে। তার বিরিশিরি যাত্রার কারনটা আরো অদ্ভুত, তার সম্প্রীতি অতি রূপবতী এক মেয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ হয়েছে, সেই মেয়েকে আমি চিনি, সে অতীব ভালো মানুষ।
রূপবতী এই মেয়ে ১৮ তারিখ যাচ্ছে বান্দরবন। নেওয়াজ সম্পর্ক জোড়া লাগাতে তাই এই সময়কেই বেছে নিয়েছে। সে বাসায় বলে এসেছে সে বিরিশিরি থাকবে কোন একটা শিক্ষা সফরে, কিন্তু আসলে সে বিরিশিরি থেকে ফিরে তার সাবেক প্রেমিকার সাথে বান্দরবন যাত্রা করবে। নেওয়াজ তার ভুল বুঝতে পেরেছে, হে রূপবতী তুমি নেওয়াজকে গ্রহন করো। নেওয়াজ তোমার জন্য একখানা গারো চাদরও কিনেছে, কালো রঙের, কালো রঙে নাকি তোমায় অপূর্ব লাগে।
যারা লেখাটি পড়ছেন তারাও এই জুটির সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে শুভকামনা জানাবেন।

ট্যুরের বাকি সদস্য আমি, নিতান্তই ভদ্রলোক, গোবেচারা ধরণের মানুষ( মেয়েরা উঠতে বললে উঠবে, বসতে বললে বসবে সেই ধরনের)  পাহাড়, পর্বত, প্রকৃতি, নদী সবুজ দেখবো বলে বিরিশিরির পথে যাত্রা করেছি। সাথে চাখতে এসেছি মালাই চা, বালিশ মিষ্টি, দ্রাক্ষারস ইত্যাদি।



নেত্রকোনার পর ভীষণ আশাহত হলাম, রাস্তা ভীষণ খারাপ, ভীষণ ঝাকুনিতে আমি এক হাতে অণ্ডকোষ ধরে স্থির রাখতে বাধ্য হলাম।
দুপুর ১ টার সময়ে পৌঁছে গেলাম বিরিশিরি শহরে। শহর দেখার মতন কিছু নয়, কিছু আলু পিয়াজ, কিছু সবজি, কিছু কয়েল লাকড়ী, দুটো ভাতের হোটেল, একটি ফোন ফ্যাক্স আর একটি ফার্মেসী নিয়ে বিরিশিরি বাজার।
তবে মুদি দোকান, সেলুন এবং মুচিও চোখে পড়েছে।

প্রথমেই আমরা বাংলোর দিকে রওনা দিলাম। চমৎকার ছবির মতো সাজানো দোতলা বাংলো। সামনে বাগান, পুকুর, ডাইনিং। রুম ঠিক করে নিলাম দোতালায়, এক ডাবল রুম ৬৫০ টাকা। একরাত। এছাড়াও যারা স্ত্রী অথবা প্রেমিকাসহ যেতে চান তাদের জন্য রয়েছে এসি রুম। তবে বৃহস্পতিবার রুম খালি থাকে না, শনিবার রাতের পর আবার খালি পাওয়া যাবে। আগে পেতে চাইলে আপনাকে ফোন করে বুক করতে হবে।
বাংলোর নাম YWCA ট্রেনিং অ্যান্ড রিসার্চ। নীচে হলরুম এবং দোতালায় থাকার ব্যবস্থা। এছাড়াও থাকতে পারবেন YMCA এর বাংলোতে, তবে সেখানে পাশেই পুকুর আর বাংলো একতলা। যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করলে সেখানে প্রচুর মশা থাকার কথা, তাই আমরা YWCA থাকার সিধান্ত নিয়েছি।

এছাড়াও আছে স্বর্ণা গেস্ট হাউজ। সেখানের বাথরুম এবং অবস্থান আমার পছন্দ হয়নি, মেইন রাস্তার উপর হোটেল, যদি এত শব্দ শুনতেই হয় তবে আর ঢাকা ছেড়ে বিরিশিরি কেন?

বিরিশিরিতে রিক্সা ড্রাইভাররাই আপনাদের গাইড। তবে এদের সব কাজে বিশ্বাস করবার দরকার নেই এবং অতিরিক্তি নির্ভর করবারও প্রয়োজন দেখি না। এদের সময়ের টাকা সময়ে মিটিয়ে দিতে হবে, এরা বার বার বলবে একবারে টাকা নেব, সেই ফাঁদে যেন পা দেবেন না।

বিরিশিরি যেতে হবে জোড় সংখ্যায়, বেজোড় সংখ্যায় গেলে আপনার ভীষণ বিপদ, কারন ঘুরতে হবে আপনার রিক্সায়, আর রিক্সায় দুজনের বেশি ওঠা সম্ভব নয়। ছোট এবং হাওয়াই রিক্সা সব বিরিশিরিতে। অতএব যাবেন তবে ২, ৪,৬ ,৮...............n ইত্যাদি সংখ্যায়। নয়ত বেজোড় জনের খরচ হুড়মুড় করে বেড়ে যাবে।

রুম ভীষণ পছন্দ হল আমাদের। গোসল যখন সারলাম তখন সবার পেটে নীল তিমি নাড়াচাড়া করছে। বাজারে গেলাম খেতে, রাস্তায় উপরেই মিখাইল দেবনাথের দোকান “ সঞ্জয়” সঞ্জয়ের আবার দুটি শাখা, একটি ভাত খাবার, একটি সকালের নাশতা+ চা খাবার।

দেশী মুরগীর মাংশ দিয়ে আমি গুনে গুনে তিন প্লেট ভাত খেলাম, রান্না আহামরি কিছু নয়, তবে আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত ছিলাম, মিখাইল দেবনাথের গল্পটাও আপনার ছুঁয়ে যাবে, গত ২২ বছর সে ঢাকা শহরে এখানে সেখানে ব্যবসা, চাকরী করেছে, কিছুই জমাতে পারেনি, গত দুই বছর ধরে মিখাইলের স্ত্রী রাস্তার পাশে একটা চৌকি পেতে সেখানে চিতই পিঠা, নারকেলের পিঠা বানিয়ে বিক্রি করেছে, মিখাইলও তাকে চার হাত পায়ে সমর্থন জুগিয়ে গেছে, স্বামী-স্ত্রীর কঠিন পরিশ্রমের ফসল বাজারের উপর এই দুইটি দোকান।

খাবার পরেই শরীর ছেড়ে দিল সাথে যাত্রার ক্লান্তি। ঘণ্টা দেড়েক ঘুমিয়ে নিলাম আমরা।

বিকেলের দিকে বের হলাম, টার্গেট গারো পাহাড়, চায়না মোড়, নলুয়াপাড়া বিজিবি ক্যাম্প এবং জিরো পয়েন্ট। রিক্সা নিয়ে যেতে থাকলাম, রাস্তা বড় খারাপ, মাঝে মাঝেই নেমে যেতে হয়, এর মাঝেই পার হলাম সোমেশ্বরী নদী। সে বড় নিরব নদী, বড় মায়াবতী নদী, হাটুর কাপড় গুটিয়ে নদীর মধ্যে যাওয়া যায় অনেকদূর। বুকে তার অনেক ক্ষত, এখানে সেখানে চর জেগেছে। চরগুলোও খাঁ খাঁ করছে। সেতুর উপরে বসে ছিলাম কিছুক্ষন। এরপর নদী পার হয়ে দূর্গাপুর বাজার, বাজার পার হয়ে চায়না মোড় পৌঁছুতে সময় লাগে আরো ৪৫ মিনিটের মত। এরপর আর রিক্সা যাবে না। এবার পাহাড়ের গা চড়ার পালা। ধানক্ষেতের আইল ভেঙে এগিয়ে চললাম পাহাড়ের দিকে, পাহাড়ে পৌঁছে চড়ার পালা, সাথের বন্ধু নাভেদ খুবই বেকায়দায় পরে গেল, তার ভারসাম্য খুব নাজুক। একটুতেই এদিক অদিক গড়িয়ে পরে। এবং মাটির সকল কোনা ওঠার পথে তার বিশাল পায়ের চাপে ভেঙে যায়, তার পরে উঠছিলাম আমি, আমার পা আটকাবার কোণা খুঁজে পেতে খুব কষ্ট হয়েছিল।

শেষ পর্জন্ত আমরা চলে গেলাম পাহাড় চূড়ায়, অদ্ভুত এক রোমান্স। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, বিশাল বিশাল গাছের মাথা সব আমাদের পায়ের নীচে। পাহাড়ের নীচের দিকের ঢালে আনারস গাছের সারি, বুনো পাতা কাটা, ছোট ছোট ঝোপ আর সুড়ঙ্গও আছে, পাহাড় থেকে নামলাম বিপরীত পাশের দিক থেকে, এরপর গারো গ্রাম হয়ে বিরিশিরির শেষ পাহাড়ের দিকে যাত্রা।
এবারের পাহাড় চড়তে ঝামেলা হোল না, গারোরা সেখানে ইতোমধ্যে খাজ কেটে সিড়ি তৈরি করে রেখেছে, সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে উঠে গেলাম, মাথায় যখন চড়লাম তখন একদম গোধূলি, দেখা যাচ্ছে জিরো পয়েন্ট, সেখানে কালো কাঁটাতারের বেড়া, একপাশে তার বাংলাদেশ এক পাশে ভারত, ভারত অংশে উচু চৌকি দেখা গেল বিএসএফ এর। বহু নীচে দেখা যায় নালা, আর পায়ে হেটে চলার রাস্তা।

আমার তখন ঘামে গোসল করে ফেলেছি, পানি পান করে কিছুক্ষন জিরিয়ে নিলাম, অইদিকে আবার সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, ফেরার তাড়া।

চায়না মোড়ে এসে খেলাম নারিকেলের পিঠা আর মালাই চা, অসাধারন স্বাদ। এরপর নলুয়াপাড়া ক্যাম্প পার হলাম, দূর্গাপুর বাজারে এসে হামলা করলাম ঘোষের দোকানে। সেখানে ইয়া বড় বড় সাইজের বালিশ মিষ্টি। কোল বালিশের মতো দেখতে বলে এর নাম বালিশ মিষ্টি। তেল ছাড়া পরোটা আর দুটো বালিশ মিস্টি খেলাম আমি, বাকিরা একটা করে। ৩০০ টাকা কেজি, এক কেজিতে ৭-৮ টা মিষ্টি উঠবে। আপনি চাইলে ওরা সুন্দর করে প্যাকেট করে দেবে, আপনি ঢাকা নিয়ে আসতে পারবেন। তবে হ্যাঁ, বিরিশিরিতে পোকা খুব জ্বালায়, একটা বাতি পেলেই হয়, সেই বাতির আশে পাশে লাখ লাখ পোকা মজমা বসায়, তাই মিষ্টি কেনার আগে দেখে নেবেন হাড়িতে পোকা পরে আছে কিনা।

ফিরে এসেই সবাই গো ধরল তারা দ্রাক্ষারস পান করবে, গারো পল্লীতে তৈরি এলকোহলের নামই দ্রাক্ষারস। আমি বলেছিলাম আমি যাই আনতে, রিক্সাওলা আমাকে ধানাই পানাই বিজিবি, সাদা পোশাকের পুলিশের ভয় দেখালো,বাকিরাও ভয় পেয়ে গেল, এবং আমাকে যেতে দিল না। বিনিময়ে রিক্সাওলা দ্রাক্ষারসের সাথে পানি মিলিয়ে আনলো, এবং সেই পানি টিউবওয়েলের। সেখানের পানিতে আয়রন থাকে প্রচুর, তাই শেষমেষ দ্রাক্ষারসের রং দাঁড়ালো লালচে সাদা। সেই রঙের দ্রাক্ষারসই পান করে নিলাম।
দ্রাক্ষারসের প্রভাবে সবার মনে কথা বেড়িয়ে এলো। এই যেমন অমির বাবার এখন টাকার অভাব নেই, নাভেদ কতবার ফোন করে রমণীকে, কত মিস করে, জীবন উৎসর্গ করতেও তার বাধবে না ইত্যাদি।
বিপরীতে আমি ছিলাম সতর্ক ও সাবধানী। তবে আমারও শরীর ভীষণ গরম হয়ে গিয়েছিল।

এরপরে আমার মাথা থেকে বের হোল সোমেশ্বরী নদীতে জলকেলী করার প্লান, প্রথমে কেউ গুরুত্বনা দিলেও দ্রাক্ষারসের প্রভাব গাড় হয়ে আসার সাথে সাথে রিক্সাওলাকে ফোন করা হল।

সোমেশ্বরীর হাটু পানিতে চলল উৎসব আর জলকেলী। সে বড় মায়াবতী নদী, তার বুক থেকে তোলা হচ্ছে কয়লা, ধরা হচ্ছে মাছ, খননের নামে শুষে নেয়া হচ্ছে বালি, কয়েকজন যুবক তার বুকে নির্মম ভাবে লাফালাফি করছে তবু সে শান্ত। তিরতির করে বয়ে চলছে সে নদী।

( চলবে)

Tuesday 28 August 2012

সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (২)


প্রথম পর্ব পড়ে নিতে পারেন এখান থেকে।
সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (১)

ঘুম থেকে উঠলাম ঘণ্টা তিনেক পর,ততক্ষণে আমার সাথে থাকা ছেলেটি জুতা মুজা খুলে বসেছে আর টিভিতে দেখছে স্থানীয় সংবাদ। সংবাদের কি বুঝছে সে,সেই জানে। নক পেয়ে দরজা খুললাম,আরো একজন আমাদের সাথে এসে যোগ দিল। তার নাম আসিফ,আমাদের মধ্যে এক জুটি ছিল,তখন টের পেলাম। ছেলেটি মেয়েটিকে একান্তে পাবার লক্ষে তার রুম থেকে আসিফকে বের করে দিয়েছে।  আসিফ মন খারাপ করে বসে আছে। আমারও মনে খারাপ কারন দুই মেয়ে,একজন জুটিতে,রইল বাকি  মাত্র এক।

ছেলেরা একসাথ হলে সেখানে নারী শরীরের বর্ননাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং নিখুঁত। আসিফ বলল মেয়েটি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে রুমে ঢুকেছে,আমি আমার ঠোঁট দিয়ে লিপস্টিক চেটে খাবার ভঙ্গি করে দেখালাম,বাকি দুজন খুবই মজা পেল এবং বাহবা দিল।
দুই বিছানার মাঝখানে ইন্টারকম টেলিফোন। আংরেজি ছবিতে দেখেছি ফোন তুলে খাবার অর্ডার করলেই খাবার চলে আসে। আমিও ফোন তুলে নিলাম কানে, ডিরেকশন শুনে রুম সার্ভিস এর জন্য জন্য ১০৩ বা ১০৪ এই জাতীয় একটা ডিজিট প্রেস করলাম,মিনারেল পানি আর কফির অর্ডার করলাম,কারন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হোটেলের বুফেতে,অর্ডার দিয়ে খেলে পয়সা লাগবে। অতএব কফিই সই। নিজেকে আংরেজি ছবির নায়ক নায়ক মনে করতে লাগলাম।

হাতমুখ ধুতে ধুতে কফি চলে আসলো। আসিফ এবং রাফি বিভিন্ন গঠনমূলক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। আমি কফি খেয়ে নেমে গেলাম নীচে,মেইল করতে।
মোস্তফা গেমস খেলার মতো বক্স কম্পুটার। ৩০ মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেট বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। মেইল বক্সে আমাদের সাথের আরেক ছাত্র প্রত্যয় এর প্রেমিকার একটি মেইল পেলাম,রমণী প্রেমিকের জন্য খুব টেনশন করছে।

 পিতা মহাদয়কে মেইল দিলাম,যে হোটেলে আছি,কোন সমস্যা নাই। ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম

- হ্যাভিং ফান উইথ ফ্রেন্ডযযয( এস নয় বরং ইংরেজি জেড দিয়ে লিখতে হবে) ইন আবুধাবী এয়ারপোর্ট হোটেল..... .
এই ধরনের স্ট্যাটাসকে বলা হয় চিল বা কুল আপডেট।  এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়। “ফ্রেন্ডয” লেখার মানে হোল আমার অনেক বন্ধু এবং সেখানে মেয়ে বন্ধুও আছে। দ্বিতীয় বিষয় লাইনের শেষে ডট ডট ডট...... অর্থাৎ ফান চলছে,এবং   ফান যেকোন দিকে টার্ন করতে পারে।

নিজেকে কুল ডুড প্রমান করে আমি এয়ারপোর্ট এর মধ্যের দোকান পাট ঘুরে দেখতে লাগলাম,ক্যামেরার দাম খুব কম,গয়না গাটিরও,চকলেটের। অনেক শেখ দেখলাম,ঢোলা আলখাল্লা পরে মাথায় পাগড়ী বেঁধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও নেপালের দুজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হোল, তারা হোটেল বুক করেনি,তাই সারা রাত লবিতে বসে কাটাতে হবে,আমার সাথে খাতির জমাতে এলে আমি পাত্তাই দিলাম না,কারন তারা লবিতে রাত কাটাবে আর আমি হোটেলে। কিছু উপদেশ দিয়ে আমি সটকে পড়লাম। কারন নাপিত যখন মন্ত্রী হয়,তখন সে আর, নাপিত কি জিনিস চেনে না এবং চেনার চেষ্টাও করে না। এটাই স্বাভাবিক।

রাত আটটার দিকে ফিরে এলাম রুমে। গঠনমূলক আলোচনা তখনও চলছে,আমি তাদেরকে বললাম যে প্রত্যয় এর প্রেমিকা আমাকে মেইল করেছে,সবার চোখে সন্দিহান জিজ্ঞাসু। প্রত্যয়কে না করে আমাকে কেন? আমিও এক দাগ বেশি রহস্য চোখে নিয়ে বুঝিয়ে দিলাম আমাকে নয় তো কি তোমাদের মতো ফাতরাদের মেইল করবে? আমি সবাইকে বললাম যে এখন বুফেতে না গেলে মানুষের খেয়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট খেতে হবে শেষে। সবাই তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে গেল।

আমি নক করলাম মেয়েদের রুমে। বেড়িয়ে এল যে মেয়েটি সে বড়ই রূপবতী হয়েছে,ভেজা চুল,ঠোঁটে লিপগ্লস, কুসুম কুসুম রোমান্সের ইচ্ছা বাড়ি দিল মনে ভীষণভাবে। রাতে খেতে যাবার কথা বললাম,এবং কেয়ারিং হবার চেষ্টা করলাম। এটা সেটা জিজ্ঞাসা করলাম,কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, শরীর কেমন,এসিতে তাপমাত্রা ঠিক মতো সেট করতে পেরেছে কিনা ইত্যাদি। আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম- ইফ সি নিডস এনিথিং,আই এম অলঅয়েজ দেয়ার,বাই হার সাইড।
জুটিকেও জানতে সাহায্য করলাম কোথায় বুফে,এবং কিভাবে যেতে হবে।

দলবল নিয়ে আমরা বুফেতে পৌঁছে গেলাম এবং বাঙ্গালীয়ানা বজায় রেখে টেবিলে এক্সট্রা চেয়ার যোগ করে সবাই একসাথে বসলাম। নাম বুফে হলেও ওয়েটার আছে এবং তার চেহারায় উপমহাদেশীয় ছাপ। ওয়েটার কাছে আসতেই মেয়েটি বলে উঠল “ টাকলা ওয়েটার” আমরা সবাই একচোট হেসে নিলাম। মেইন কোর্স অর্ডার করল যে যার পছন্দ মতো। তবে সবাই খুটিয়ে দেখে নিল পর্ক আছে কিনা,আমি সবাইকে নিশ্চিত করলাম যে আরব দেশের এয়ারপোর্ট হোটেলে পর্ক এবং এলকোহল থাকবে না এবং তার মধ্যে এখন রোজা চলছে।

শুয়োরের বিষয়টি দেশের বাইরে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। না খেয়ে মরে গেলেও শুয়োর ছোয়া চলবে না। শুয়োরকে যত গাল পাড়বেন আপনার উপর প্রবাসীরা তত খুশী হবে। এছাড়াও রাশিয়াতে আরব ছাত্রদের দেখেছি মদের সাথে খাবার জন্য গ্রাম থেকে হালাল ভেড়া অথবা গরুর মাংস কিনে আনতে,শুয়ার কখনই নয়। শুয়োর খাওয়া ইসলামে সরাসরি হারাম। আমরা অপেক্ষা করছি খাওয়া আসার,এর মধ্যেই আমাদের জুটি পৌঁছে গেল,আমাদের কোন রকম পাত্তা না দিয়ে তারা আলাদা টেবিলে বসে গেল এবং খুনসুটি করতে লাগলো।

খাবার আসার পর দেখ গেল কেউই খেতে পারছে না,কেউ কাটা চামচ চাকুর জন্য,কেউ লজ্জায়,কেউ ভাত- মাছ না পেয়ে। সবাই তখনও চামচে টুং টাং করছে আমি ওয়েটারকে ডেকে ডেসার্ট অর্ডার করলাম, ফ্রুট কেক চাইলাম।

কেক চলে আসার পর দেখা গেল উপরে অজানা এক ফলের টুকরো। আমি সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের সন্তান,না জেনে কিভাবে খাই? যদি হারাম ফল হয়? আমি আমার ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম এই ফল কি ফল? সে জবাব দিল “কিভি” কিভি হোল বাংলাদেশে আমড়া সাইয ফল,ছিলে খেতে হয়,টক মিষ্টি স্বাদ। ভেতরের শাঁসের রং কাচা কলার মতো। আগ্রহীদের জন্য কিভি ফলের একটা ছবি দিয়েছি। পিচ ফল আর কিভি ফল এখনও আমার সবচে প্রিয় ফল।
কেক শেষ হবার পর আমি আইসক্রিম নিতে চাইলাম,ওয়েটার বলল
- স্যার ইউ হ্যাভ অলরেডী অর্ডারড ইয়োর ডেসার্ট,ইউ ক্যান নট অর্ডার এগেন।

ইজ্জতের পায়জামা খুলে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল ব্যাটা। জুমার নামাজের দুই রাকাত ফরজ নামাযের জামাতের পর আপনি মসজিদে প্রবেশ করলে আপনার দিকে মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে,সবাই আমার দিকে সেইভাবে তাকিয়ে রইল।
আমি হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিষয়টা ঠিক উড়ল না।

পেটপূজা সেরে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। সবাই আমার রুমে বসল,বিভিন্ন গল্প গুজব করছি,কে কিভাবে এপ্লাই করেছে,কার বাড়ি কই,ভাই বোন কতজন,কে কয়টা প্রেম করেছে ইত্যাদি। আমি হাই তুলে বললাম- এক প্যাকেট তাস নিয়ে আসা উচিত ছিল,২৯ খেলা যেত,সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি সবাইকে হেমলক বিষ খেতে বলেছি।

মেয়েটি বিদায় নিল,তার নাকি ঘুম আসছে। এরপর আমি প্রস্তাব দিলাম সবাইকে,নীচে যাওয়া যাক,অনেক নারী যাত্রী আছে,পরিচিত হওয়া যাক,কথা বলা যাক আফটার অল দেয়ার ইজ আ থিং কল্ড “ ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড” কিন্তু সবার অনাগ্রহ দেখে মনে হোল আমি একদল সমকামীর মাঝে এসে পড়েছি।

একজন প্রস্তাব দিল গানের কলি খেলা যায়। আমি একটা সিধান্তে পৌঁছে গেলাম,হয় আমি ভিন গ্রহের বাসিন্দা,নয়ত এরা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা।
সহসা রুমের ফোন বেজে উঠল,সবাই একযোগে আমার দিকে তাকালো। আমি উঠে গিয়ে ফোন ধরলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হোল কেউ রোজা রাখবে কিনা? তাহলে ভোররাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়া হবে ফোন করে,এবং খাবারের ব্যবস্থা আছে। আমি বললাম অবশ্যই,আমরা সবাই রোজদার।

ফোন রাখার পর সবাই জিজ্ঞাসা করল আমি কেন হ্যাঁ বললাম,আমি তো গতকালও রোজা ছিলাম না,তাছাড়া,আমরা কোথায় ইফতারী করব? মস্কো পৌঁছে আমাদের ইফতারের ব্যবস্থা কে করবে?
আমি সোজা সাপটা বলে দিলাম যে আমাদের প্রিয় নবীজী( দঃ) সবসময় সেহরী খেয়েছেন,এবং সাহাবীদের সেহরী খাবার জন্য উৎসাহিত করেছেন,আমি সেহরী এবং ইফতার ছেড়ে দিয়ে পাপের ভাগীদার হতে চাইনা।

এরপর যে যার রুমে চলে গেল,সিধান্ত হোল,যার ইচ্ছা সে খাবে,যার ইচ্ছা না সে সেহরী খেতে যাবে না।
( চলবে)

Sunday 26 August 2012

সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (১)


আজ আমার প্রবাস জীবনের ৩ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের এই দিনে বাক্স পেটরা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমার মা হাপুস নয়নে কান্না কাটি করছিলেন,সাথে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছেন আমার বড় ফুপি। আমি দুজনের কাছ থেকে একটু আড়ালে থাকছি,কারন কান্না বিষয়টা বমির মতো,দেখলেই পেয়ে যায়।

পকেটে কিছু বাংলাদেশী টাকা ছিল, ভাগ করে দিয়ে দিলাম আমার ছোট ভাইকে আর ফুপাতো ভাইকে। আমার বাবা আমাকে বিভিন্ন উপদেশ দিতে লাগলেন। কিভাবে সাথে থাকা ডলার এবং সুটকেস নিরাপদে রাখতে হবে,বিপদে পড়লে কি করতে হবে,সুটকেস মিসিং হয়ে গেলে কি করতে হবে এইসব।

আমার সাথে আরো যাচ্ছে ৬ জন সরকারী স্কলারশীপ প্রাপ্ত ছাত্র এবং দুইজন ছাত্রী। সবাই বেশ কান্নাকাটি করছে,একজনের দেখলাম প্রেমিকাও এসেছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চেক ইনে দাঁড়ালাম। একজন ছাত্রী আমার সাথে পরিচত হবার চেষ্টা করল,নাম ধাম, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। আমি সযত্নে উত্তর করে এড়িয়ে গেলাম,কারন সামনে দীর্ঘ পথ,আবু ধাবী তারপর মস্কো। অতিরিক্ত খাতিরের ফলাফলে আমার ঘাড়ে তার বাক্স পেটরা উঠিয়ে দেবার সম্ভাবনাই ৯০ ভাগ। অতএব যাত্রাপথে আমি কুসুম কুসুম রোমান্সের আশা পরিত্যাগ করলাম।

সেই রমণী আর আমি এখন একই শহরে পড়াশুনা করি,আশা করি রমণীর চোখে এ লেখাও পড়বে,এবং রমনী এই অধম রমনকে মাফ করিয়া দেবে।

বাক্স পেটরা প্লেন কোম্পানীকে গছিয়ে দিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সামনে সুইডেন গামী একদল শ্রমিক ভাই,তাদের গায়ে একই রঙের গেঞ্জি,মাথায় একই রঙের ক্যাপ। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম,তারা একই কোম্পানীতে চাকরী করতে যাচ্ছে। ইমিগ্রেশনে যাতে ঝামেলা না হয় এই জন্য ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে এই কাপড় পরিয়ে দিয়েছে,আরো জানতে পারলাম ভিসা লাগাতে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে মাথা পিছু। শ্রমিক ভাইদের বিদায়ের পর আমার পালা।

ডেস্কে বসা পুলিশ আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল,মস্কো যাচ্ছি শুনে তার পরিচিত এক আত্মীয়ের নাম এবং ফোন নাম্বার আমাকে লিখে দিল। আমিও বিনয় প্রদর্শনে কার্পন্য করিনি একফোটা। বাত-চিত শেষে আমার পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখার পালা,কম্পুটারে নাম্বার ঢুকাতেই বিদ্যুৎ চলে গেল,মেজাজ গরম করে অফিসার আমাকে সিল ছাপ্পড় মেরে দিল কারন ব্যাক আপ জেনারেটর চালু হতে হতে ৩ মিনিট লাগে,আর সিস্টেম রিস্টোর হতে আরও ৪-৫ মিনিট। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার মতো বাজে সময় অফিসারের হাতে নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম বাহ! আমি যদি আজ সাজাপ্রাপ্ত ফেরারী আসামীও হতাম,পার হয়ে যেতাম নিশ্চিন্তে।

এয়ারপোর্টের ভিতরে কিছু খাবারের দোকান আছে,সেখানে ১০ টাকা দামের মাম পানির বোতলের দাম ৭০ টাকা, বনরুটি সাইয বার্গারের দাম ৩৬০ টাকা,রোল পরোটা ৩৫০ টাকা ইত্যাদি।
আমি জীবনে প্রথমবারের মতো ডিউটি ফ্রি মার্কেট দর্শন করে ভীষণ হতাশ হলাম। কুকুরের পেটে ঘি সয় না,আর গরীবের গায়ে এসি সয় না। ভিতরের শীতল বাতাসে আমার ভীষণ শীত শীত করতে লাগলো। বসার জন্য সুন্দর জায়গা আছে,সেখানে নানা কিসিমের মানুষের ভিড়,বেশির ভাগই শ্রমিক ভাইয়েরা। আর একটু উচু দরের যাত্রীরা নিজেদের আলাদা বলয় সৃষ্টি করেছে, সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করছে,বেশির ভাগ কথাই বলছে ইংরেজিতে, যেখানে আটকে যাচ্ছে সেখানে বাংলা।

উড়োজাহাজের পেটে চাপিয়া বসিলাম। একপাশে এক মস্কোগামী এক ছাত্র অন্যপাশে অপরিচিত এক ভদ্রলোক,বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃস্টি,মনের মধ্যেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মায়ের সাথে কথা বলছিলাম সেল ফোনে। অসম্ভব রূপবতী এক রমনী এসে বলল
- স্যার প্লিজ টার্ন অফ ইউর ইলেকট্রনিক ডিভাইসেস।
ভাগ্যিস স্কুল কলেজে ১২ বছর আংরেজি শিখেছিলাম নয়ত যাত্রাপথে বহু সমস্যা হয়। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া,তখন চলছিল রোজা। প্লেনের অধিকাংশ যাত্রী ওমরা হজ করতে যাচ্ছে। আমার ধারনা ছিল শুধু মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই ওমরা হজ করেন,বিশাল হজ বহর দেখে ভুল ভাঙল।

উড়োজাহাজ আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে যাত্রীদের খচর মচর শুরু হয়ে গেল,বোম্বে চানাচুর,বন রুটি,কলা কিছুই বাদ থাকলো না। এবং খাবার পর অনায়াসে প্যাকেটগুলো ঝড়ে পড়তে লাগলো প্লেনের মেঝেতে।

আমি সোজা বোতাম টিপে ভদকা আর কোকের অর্ডার করলাম,ফ্রি প্রিমিয়াম এলকোহল যতদূর কনজিউম করা যায় ততখানিই লাভ,এই ছিল দর্শন। বাঙ্গালী ফ্রি পেলে শাদা লুঙ্গিতে আলকাতরা তুলে নেয় আর সেখানে এলকোহোল। কোথায় আগরতলা কোথায় খাটের তলা।

পাশের যাত্রীরা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। এসব চক্ষু উপেক্ষা করা প্রথমে প্রথমে একটু কষ্টকর।
ঘণ্টা খানেক পর এক ওমরা যাত্রী এয়ার হোস্টেসকে ডেকে নিয়ে হজ এর শানে-নুজুল,সওয়াব ইত্যাদি বুঝিয়ে বলছিলেন। রমনীর গরু চোখ দেখে আমার পেটের মধ্যে হাসি গড়িয়ে গেল,এক অক্ষর বুঝতে পারছিল না রমণী। নিজের ইংরেজি দক্ষতার প্রদর্শনী দেখিয়ে আমি অনুবাদ করে দিলাম মূল অংশ।

এরপর খাবার পালা,সাটিয়ে বসলাম তাছাড়া আমার মৃদু এলকোহলের পর খাবার রুচি বাড়ে। যা খাবার দিল,সেই রকম খাবার তিন বার চালালেও আমার পেটের আধা ভরবে না।
খাবার পর চা/ কফির আয়োজন। আমি এসব ছেড়ে রেড ওয়াইন চেয়ে বসলাম। আমার কাণ্ড কারখানায় সাথে ছাত্র ছাত্রীরা খুবই বিরক্ত,পারলে প্লেন থেকে নেমে পরের প্লেনে আসে এমন অবস্থা। অথবা ফোন করে আমার বাপের কাছে নালিশ দেয়।

দামী বিমান বলে কথা, সেখানে মিউজিক শোনা এবং মুভি দেখার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে দুইএকজন কানে হেডফোন লাগিয়ে রক মিউজিক শুনতে লাগলো এবং মাথা সামনে পেছনে দোলাতে লাগলো। এই গান শোনা পার্টি আমার খুবই বিরক্ত লাগে,আমি বিশ্বাস করি কণ্ঠ আছে অতএব গান শুনলে নিজের গলায়। এদের কাজ কারবার দেখলে মনে হয় মায়ের পেট থেকে পড়েই রক মিউজিক শোনা শুরু করেছে,ওয়াইন শেষ করে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে নিলাম তখন দেখি মুসুল্লী পার্টী প্লেনের খাবার প্যাকেটে ভরছে,কারন তারা রোজা। এই নাহয় বাঙ্গালী,নামে যেমন কাজেও তেমন।

৬ ঘণ্টা ওড়ার পর নামার সময় হয়ে এল,নামার সময় তলপেটে অদ্ভুত এক চাপ অনুভুত হয়,যেই সেই না একদম বেশ ভালো একটা চাপ। সহিহ সালামতে নেমে আসলাম আবুধাবী বিমান বন্দরে। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি।

আবু ধাবীতে আমাদের ২৩ ঘন্টার যাত্রাবিরতি। চেকিং এর আনুষ্ঠানিকতা সেরে পৌঁছে গেলাম বিমান অফিসের ডেস্কে। উল্লেখ্য এই যে, সব জায়গায় কথা বার্তা আমিই চালিয়েছি,হাজার হোক গত ৫ বছরের আংরেজি মিডিয়ামে পড়বার অভিজ্ঞতা বলে কথা। তবে ইদানীং ফেশবুকে যেভাবে ইংরেজি চর্চা হচ্ছে তাতে মাঝে মাঝে বড় দোটানায় পড়ে যাই। আসলে কোনটা সহি আংরেজি? যেটা স্কুল কলেজে শিখেছি নাকি যেটা কুল ডুডসরা লেখে সেটা?

এয়ারপোর্ট হোটেলের কার্ড নিয়ে হোটেল রুমে চলে এলাম,সেখানে এক রাত থাকার আয়োজন এবং ৪ বেলা খাবার আয়োজন করা হয়েছে। চাবি ছাড়া তালা দেখলাম সেই প্রথম,খোপের মধ্যে কার্ড ভরে দিলে দরজা খুলে যাচ্ছে,আহা সে যেন জাদুর বাক্স। ভিতরে আর একটা স্লট,সেখানে কার্ড সেট করলে বিদ্যুৎ সংযোগ। চমৎকার সাধু। অর্থাৎ কেউ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে বিদ্যুৎ অপচয় হবার কোন সম্ভাবনা নেই। সরকারী অফিস আদালতে এই সিস্টেম করলেও পারে।
এছাড়াও রুমে ঢুকেই এসির রিমোট হাতে নিয়ে একটা নাতিশীতোষ্ণ টেমপেরেচার সেট করে বাকি সবাইকে দেখিয়ে দিলাম যে আমি নিতান্ত ফেলনা নই। প্রতি রুমে দুইজন করে মোট ৪ রুম দেয়া হোল আমাদের।

আমার সাথের ছেলেটা একটু আড়ষ্ট বোধ করতে লাগলো,সে বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। আমি তার সামনেই কাপড় চোপড় খুলে গোসল করতে ঢুকে গেলাম,তার চক্ষু কপালে,অবশ্য আমার দোষ না,আমার হ্যান্ড লাগেজে কোন কাপড় ছিল না। আমি নিরুপায়। বাথটবে ঘণ্টা খানেক দাপাদাপি করে ফিরে এসে দেখি ছেলেটা সেই একই জায়গায় চুপচাপ বসে আছে। বললাম গোসল করতে যেতে,না বোধক মাথা নাড়ল সে। আমি চুপচাপ টিভি ছাড়লাম,বোরিং আরাবিক চ্যানেল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
( চলবে)

Wednesday 22 August 2012

বাঁচুক সবাই মানুষ হয়ে


সদরঘাট,ঢাকা

সকালে ঘুম থেকে জেগেই কোন কাজ না করার সিধান্ত পাকা করে ফেলল মহসিন। আশে পাশে কেউ নেই,আগোছালো কাঁথা,বালিশ স্তূপ হয়ে রয়েছে। মহসিনের পাশে যারা ঘুমায় তারা বেশিরভাগই রিক্সা চালায়,সাত সকালে উঠেই কাজে চলে যায়। ঢাকা শহরে মনে হয় কম খরচে এর থেকে ভালো ঘুমানোর ব্যবস্থা আর নেই। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর কাঠের লম্বা ঘর,উপরে টিনের চালা,রাত প্রতি ২০ টাকা,কাঁথা বালিশ বিছানোই থাকে,টাকা দিয়ে ঢুকে শুয়ে পড়লেই হয়। তবে মালিক গত মাসে বলে গিয়েছে আগামী মাস থেকে ৩০ টাকা রেট। আপাতত এ নিয়ে ভাবছে না মহসিন।

মোট তিন রকমের কাজ করে মহসিন,সপ্তাহে তিন দিন ময়লার গাড়ি নিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি,বাকি তিন দিন ভ্যানে সবজিবিক্রেতা কমলের সাথে সবজি বিক্রি করে,আর বাকি একদিন কিছুই করে না,ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে রাতে রাতে স্বর্ণকারদের দোকানের পাশের ড্রেন থেকে ময়লা তুলে এনে পানিতে পরিষ্কার করে। মাঝে মাঝে সেই ময়লার মাঝেও মেলে এক দুই দানা সোনা, দিনে সেই একদানা সোনা আবার স্বর্ণকারদের কাছেই বিক্রি করে। তবে রাতে সোনার দানা পাবার সম্ভবনা খুব কম থাকে,কারন দোকানের ময়লা ফেলা হয় বিকেলে,সন্ধ্যার পর ময়লা ফেললে নাকি অমঙ্গল হয় ব্যবসার। যেদিন এক দুই দানা সোনা মেলে সেদিন একটু ভালো যায় মহসিনের,২০০-৩০০ কাঁচা টাকা আসে পকেটে,সেই সব দিন গুলোতে সিনেমা দেখতে যায় মহসিন,সন্ধ্যার শো। সিনেমা দেখে বের হয়ে একটা কুলফি মালাইও খায়। মালাই চাটতে চাটতে লোকাল বাসে করে ফিরে আসে বুড়িগঙ্গার পাড়ে।

 তবে কয়লা দিয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারে মহসিন,খয়েরি রঙের কাগজের উপর একবার একটা ছবি একেছিল সে,প্রিয় নায়িকা শাবনুরের ছবি। সেই ছবি লুকিয়ে রেখেছিল বেগুনের ঝুড়ির নীচে। বেগুন কিনতে এসে এক রমণী সেই ছবি দেখে ফেলে,বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয় মহসিনের যে ছবিটি তারই আকা

আসমানী- এই ছেলে,এই ছবি তুমি এঁকেছ?
মহসিন- জি আফা।
- তুমি সবসময় ছবি আঁক?
- জি না আফা।
- একটা ছবি দিলে দেখে আঁকতে পারবে?
- কার ছবি আফা?
- আমার একজন প্রিয় মানুষের।
- পারমু আফা।

আসমানী তাকে সুদর্শন এক রমনের ছবি ধরিয়ে দিল। সাথে দিল ৩৫০ টাকা। ছবি আঁকতে হবে কাপড়ের উপর,যেই সেই কাপড় না,মোটা কাপড়ের উপরে। এই ছবি প্রিয় মানুষকে উপহার দেবে আসমানী। মোটা কাপড় কিনে বুড়িগঙ্গার সেই চালা ঘরে ছবি আঁকতে বসেছিল মহসিন। রাতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল,একজন এক কাপ চাও এনে দিয়েছিল,কয়েকজন বিড়ি নিয়ে বসে গিয়েছিল গল্প করতে, একজন বলেছিল একটা ন্যাংটা মেয়ের ছবি আঁকতে,বাকিরা তাতে সায়ও দিয়েছিল।

তিনদিন পর ছবি নিয়ে গিয়েছিল মহসিন। ছবি আর কাপড় কেনার পর বাকি ৯০ টাকা ফেরত দিয়েছিল আসমানীকে। আসমানী মিষ্টি হেসে তাকে আরো ৩০০ টাকা ধরিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে। সেদিন শাকিব খান-অপু বিশ্বাস এর একটা ছবি দেখেছিল মহসিন,ছবির পর এক হোটেলে ঢুকেছিল নান রুটি আর সবজি খেতে,হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিল মহসিনকে,ময়লা কাপড়ে নাকি এসব জায়গায় ঢোকা যায়না।

পড়াশুনা করতে পারেনি সেই অর্থে মহসিন, সিডরে সব ভেসে যাবার পর ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছিল,ভাগ্য তো ফেরেনি,বেড়েছে দুর্দশা,কখনও এক পেট খেয়েছিল,কখনও আধাপেটা,পার্কে ঘুমিয়েছে,রেল স্টেশনে,হিরোইন খোর সন্দেহে একবার জেলেও ছিল একরাত। জীবন যেখানে যেমন। তবে আক্ষেপ নেই মহসিনের। সবাই যদি গাড়ি ঘোড়া চড়তে শুরু করে,সবাই যদি শিক্ষিত হয়ে যায়,সবাই যদি ভদ্দরলোক হয়ে যায় তখন তো আর দুনিয়া চলবে না। তাছাড়া সবাই ভদ্দরলোক নাকি,ভদ্দরলোক নামী বহু খারাপ মানুষও আছে,শার্ট প্যান্ট পরা অনেকেই তো সদরঘাট আসে হেরোইন কিনতে,কত বিবাহিত ভদ্দরলোকের আছে আলু-পিয়াজের দোষ। এর থেকে মহসিনের ময়লা মাখানো জীবনটা বহু ভালো আছে। ময়লার মধ্যে থেকেও,ময়লা ঘেটেও মনটা রেখেছে পরিষ্কার। আলু-পিয়াজের দোষও নেই,নেই কোন মাদকাসক্তি।

শার্ট চাপিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এল মহসিন। রাস্তার কলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিল,বড় রাস্তায় উঠে বাম দিকের বাড়িতে একটা প্লাকার্ড দেখতে পেল মহসিন,সেখানে লেখা “ আজ শুভর জন্মদিন”  নিজের জন্মদিন কবে মনে করতে পারলো না মহসিন,স্কুলে ভর্তি হবার সময় মাস্টার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “ মহসিনের জন্ম তারিখ কবে?”
মা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন “ মাস্টার সাব,তারিখ তো মনে নাই,তয় তালের সময় হইছিল মহসিন”
মাস্টার বাধ্য হয়ে মনমতো একটা জন্মতারিখ বসিয়ে দিয়েছিলেন। ঝামেলার কথা হোল সেই মনগড়া তারিখটাও মহসিনের মনে নেই। হুট করে আরো একটা সিধান্ত নিয়ে নিল মহসিন,আজই তার জন্মদিন। আজই সে পালন করবে জন্মদিন।

মোড়ের হোটেলে ঢুকেই,সুপ,পরাটা আর চায়ের অর্ডার করল মহসিন,জন্মদিনে ভালো মন্দ না খেলে উপরঅলাও রাগ করবেন। খাওয়া শেষ করে পাশের স্টেশনারী দোকানে ঢুকলো
- ভাই কেক আছে?
- কেমন কেক?
- গায়ে মেখে গোসল করার কেক
- ফাইজলামী করিস?
- তাইলে কেক আবার কেমন হয়? খাওয়ারই তো হয় নাকি?
-কয় পিস?
- এক পিস
- ১০ টাকা দে।

 কেক মুখে দিয়ে নিজের জন্মদিন পালন করল মহসিন,বিচ্ছিরি কেক,সস্তার তিন অবস্থা,চিনি আর ডালডা, দুনিয়াটা ভেজালে ভরে গেল ভাবতে ভাবতে কেক ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহসিন। জন্মদিনে যদি একটুকরো কেকই না খাওয়া গেল।

একটা ফোন ফ্লেক্সীলোড এর দোকানে ঢোকে মহসিন,কাউকে ফোন করে জেনে নিতে হবে কোথায় আছে ভালো কেক,একপিস কেক না খেলেই নয়।
ফোন সামনে নিয়ে বসে আছে এক তালপাতার সেপাই,এর মধ্যে আবার সে খানদাণী গোফ রেখেছে,দেখেই হাসি পেয়ে গেল মহসিনের। ¬
- একটা ফোন করবার চাই।
- কাকে?
- আপনার বউরে
- বেয়াদ্দপের বাচ্চা,থাপড়াইয়া কানসা লাল করে দিমু।
- আপনেই তো জিজ্ঞাসা করলেন,আপনার কি দরকার আমি কারে ফোন করি? কথা কমু পয়সা দিমু।
- নে ফকিরনীর বাচ্চা

মোবাইলটা বেশ বাহারী। উপরে আবার প্লাসটিকের কাভার লাগানো। কাভারটা এই মোটা, যেন মোবাইলের গায়েও রাশিয়ার বরফ ঠাণ্ডা লাগে। মোবাইলের গায়ে আবার শেকল বাধা,শেকলের আরেক মাথা বাধা দোকানদারের টেবিলের সাথে। কিন্তু এখন ঝামেলা হোল,কারো মোবাইল নাম্বারই সে জানে না। কাকে ফোন করবে সে মহসিন? মনে পড়ল আসমানী তাকে একটা কাগজে করে নাম্বার দিয়েছিল,মানিব্যাগ হাতড়ে কাগজটা বের করল,নাম্বার লিখে ফোন করল
- হ্যালো
- হ্যালো আফা সালাম
- কে বলছেন?
- আফা আমি মহসিন
- সবজি মহসিন?
- জি আফা
-কেমন আছো? কোথা থেকে ফোন করেছ?
- আফা সদর ঘাট, আমি এইখানেই থাকি।
- আমাদের এখানে কবে আসবে সবজি বেচতে?
- পরশু,আফা আজকে আমার জন্মদিন,এক পিস কেক খাইতে ইচ্ছে করতেছে,কম দামে কই পামু?
- ওমা,তাই নাকি? তুমি চলে এসো আমাদের এলাকায়,এখানে এসে ফোন দাও,আমি নিয়ে যাবো তোমাকে দোকানে,আজকে আমি তোমাকে খাওয়াবো।
- না থাক,আফা,ঝামেলা করনের দরকার নাই,আমি খুজে নিবনে। আপনি খালি বলেন
- আরে ধুর চলে আসো। আমি বলেছি না আসতে।
- আচ্ছা ঠিকাছে আফা
- কিন্তু কিভাবে আসবে? আজকে তো হরতাল।
- কি যে বলেন আফা,এইডা কোন ঘটনা? আমি একটা ব্যবস্থা করে চলে আসবো।
- আচ্ছা তাহলে।

ফোনের বিল মিটিয়ে বের হয়ে আসে মহসিন,একটা রিক্সা করে লালবাগ এর মোড়ে এসে নামলো। এখান থেকে অন্য রিক্সা নিতে হবে,রাস্তা ঘাট একদম ফাঁকা, রিক্সা ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। হাঁটতে হাঁটতে রিক্সা খোজার সিধান্ত নেয় মহসিন।

 সামনে মিছিল দেখা যাচ্ছে,রাস্তার একদম পাশ ঘেঁটে হাটতে থাকে মহসিন,মিছিলের ক্যাচালে পড়বার কোন ইচ্ছা তার নাই, বিপরীত দিকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে,মিছিলের মধ্যে বিদ্রোহের দানা গুটি বাধলো,উৎসাহী কয়েকজন পিছনে টায়ারে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়েছে,একদম বলা নেই কওয়া নেই কয়েকজন ইট ছুড়তে লাগলো,পুলিশ প্রথমে কাদুনে গ্যাসের শেল ছুড়ল,শেল ফাটলো মহসিনের ঠিক পাশে,প্রচণ্ড ধোয়াতে চোখ জ্বলতে লাগলো মহসিনের,এর পর রাবার বুলেট,ছিঁড়ে যেতে চাইল মহসিনের পা,ধোয়াতে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারল না মহসিন,তবে অনুভব করল গরম পানির স্রোত বইছে পা থেকে নীচে।

 শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো মহসিনের,কিন্তু না এখানেই যদি থেমে যায় মহসিন,হাজারো পায়ের নীচে চাপা পরে মৃত্যু হবে মহসিনের। আহত পা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল মহসিন,সেখানে দুটো দোকান দেখা যাচ্ছে। দুটো দোকানের ফাঁকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল মহসিন। একটু জিরিয়ে নিয়ে সামনে বাড়তে হবে,ধরা পরা যাবে না পুলিশের হাতে,ধরা পড়লে জেলে চালান করে দেবে,বলবে এরাই মিছিল থেকে বোমা ফাটিয়েছে।
সব কিছু ভেঙে পড়তে থাকে মহসিনের,চোখের সামনে ভেসে ওঠে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সিডর এর পানির তোড়,কানে আসতে থাকে আসমানী এর গলা, নাহ জ্ঞান হারানো চলবে না,কিছুতেই না।

এই বাংলাদেশে মহসিনদের কেউ উদ্ধার করে না,কেউ চিকিৎসা করায় না,কেউ বিশ্বাস করে না। মহসিনদের দল নেই,জাত নেই,পাত নেই তবু মহসিনেরা জেলে চালান হয় স্রোতের মতো,মহসিনদের উদ্ধার করার কেউ নেই।
মহসিনদের উকিল নেই,ক্ষমতা নেই,গদিতে বসার আকাঙ্খা নেই,পয়সা নেই,পয়সার কামনা নেই তবু কেন যেন এই বাংলাদেশে মহসিনেরা ভোগে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ,উলুখাগড়ার প্রানান্ত।

শার্ট ছিঁড়ে পা বেঁধে ফেলে মহসিন,এইতো একটু ভালো লাগছে তার। সামনের দিকে এগিয়ে চলে মহসিন। কে জানে তার মতো আরো কত মহসিন চলছে হাতড়ে হাতড়ে,বেঁচে থাকতে,একটু ভালো থাকতে,ভাগ্য ফেরাতে।

( লেখাটি পুলিশী অত্যাচারে নির্মমভাবে পা হারানো লিমনকে উৎসর্গ করছি,লিমনের মতো কেউ অমানবতার ছাপ না বয়ে চলুক। সবাই বাঁচুক মানুষ হয়ে মানুষের মতো। )

Saturday 11 August 2012


 মহুয়ার বনে সঙ্গম
- তাওসীফ হামীম ও শর্মী আমিন


মহুয়া বনে যাবে আমার সাথে?
কেড়ে নেব তোমার নগ্নতা আর লজ্জা
শীৎকারে শীৎকারে,শব্দের প্রতিধ্বনিতে বন উতলা হবে
উতলা হোক দুটি তনু

যদি শীতল চাঁদ নিজেকে লুকোয় মেঘের ঢালে
আলোতে বড্ড নির্লজ্জ লাগে

নির্লজ্জতাকে ঝেড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড় সেই আলোতে
কুরে কুরে খাও মেঘ মাখানো চাঁদের আলো
একদম শেষটুকু পর্জন্ত

মহুয়াতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হব তবে
বাকিটুকু না হয় তুমি কোরো
ফেনিল জোছনা সূক্ষ্ম মশারি হয়ে আবৃত করবে নগ্ন দেহ

মশারীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাকা ভেদ করে আমার কামনার জিহ্বা শুষে নেবে তোমার নারী সুলভ গন্ধ
ছড়িয়ে দেবে কামনার আবেশের এনথারক্স
তোমার শরীরের প্রতিটি কোষপ্রাচীর ভেদ করে পৌঁছে যেতে চাই গহীন থেকে গহীনে

উন্মুক্ত করে দিলাম নিজেকে
ব্রীড়ার ভাঁজ খুলে ডেকে নিলাম প্রবল পুরুষকে
মথিত আবেশে শিহরিত শরীর
নিষিদ্ধ প্রেমে উন্মত্ত যুগল

তোমার বুকের ঘামেও মৃগীর গন্ধের ছড়াছড়ি
সরু বাহুতে মরুভুমির মসৃণতা
কটিদেশে তোমার সমুদ্র ঢেউয়ের উদ্দমতা
এক ঝাপে হারিয়ে যেতে চাই

বুকে জমে থাকা ঘাম তুলে নেব শিকারী সাপের ন্যায়
আছড়ে পিছড়ে বেড়াবো তোমার উন্মুক্ত জমিনে
বিদগ্ধ কামনা হয়ে আশ্রয় খুঁজবো শিকারীর মত
দিন আর রাত এক হয়ে যাবে ভালবাসায়

শিশির বিন্দুর মতো ঘাম তোমার নাকের ডগায়
জানান দিচ্ছে রাগমোচনের প্রথম প্রহরের
আমার শরীরে তোমার পায়ের বন্ধন রাসায়নিক বন্ধনের মতো গড়ছে আর ভাঙছে
তীব্র পিস্টন সম হাঁপানির সাথে সাথে তোমার নিঃশ্বাস হয়েছে দ্রুত থেকে দ্রুততর

বুনো পুরুষ আজ ক্লান্ত ভীষণ
নোনা ঘামে চকচকে শরীর যেন বিজয়ীর আস্ফালন
রতিক্লান্ত মুখে সাফল্যের ছায়া
পেঁচিয়ে ধরে প্রকৃতির কটি,মুখ ডুবায় স্ফীত স্তনে

ডাঙায় তোলা মাছের মতো থর থর করে কাঁপা বুক তোমার
একটুকু মাথা রাখতেও ভয় লাগে ভীষণ,যদি আবার কাপন ধরে
যদি আবার প্রেমের নেশায় মত্ত হই যদি আবার তোমাকে ছিন্ন বিছিন্ন করার লোভ জাগে রক্তের কনায় কনায়?
কাঁপছে শরীর,কাঁপছে মন,উন্মত্ত অধরে অধর ডোবানোর আহবান
তীব্র তৃপ্তির বিজয় কেতন উড়িয়ে দুটো তনু এখন শান্ত আর একাকার।