Tuesday 28 August 2012

সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (২)


প্রথম পর্ব পড়ে নিতে পারেন এখান থেকে।
সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (১)

ঘুম থেকে উঠলাম ঘণ্টা তিনেক পর,ততক্ষণে আমার সাথে থাকা ছেলেটি জুতা মুজা খুলে বসেছে আর টিভিতে দেখছে স্থানীয় সংবাদ। সংবাদের কি বুঝছে সে,সেই জানে। নক পেয়ে দরজা খুললাম,আরো একজন আমাদের সাথে এসে যোগ দিল। তার নাম আসিফ,আমাদের মধ্যে এক জুটি ছিল,তখন টের পেলাম। ছেলেটি মেয়েটিকে একান্তে পাবার লক্ষে তার রুম থেকে আসিফকে বের করে দিয়েছে।  আসিফ মন খারাপ করে বসে আছে। আমারও মনে খারাপ কারন দুই মেয়ে,একজন জুটিতে,রইল বাকি  মাত্র এক।

ছেলেরা একসাথ হলে সেখানে নারী শরীরের বর্ননাই সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং নিখুঁত। আসিফ বলল মেয়েটি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে রুমে ঢুকেছে,আমি আমার ঠোঁট দিয়ে লিপস্টিক চেটে খাবার ভঙ্গি করে দেখালাম,বাকি দুজন খুবই মজা পেল এবং বাহবা দিল।
দুই বিছানার মাঝখানে ইন্টারকম টেলিফোন। আংরেজি ছবিতে দেখেছি ফোন তুলে খাবার অর্ডার করলেই খাবার চলে আসে। আমিও ফোন তুলে নিলাম কানে, ডিরেকশন শুনে রুম সার্ভিস এর জন্য জন্য ১০৩ বা ১০৪ এই জাতীয় একটা ডিজিট প্রেস করলাম,মিনারেল পানি আর কফির অর্ডার করলাম,কারন আমাদের খাবারের ব্যবস্থা হোটেলের বুফেতে,অর্ডার দিয়ে খেলে পয়সা লাগবে। অতএব কফিই সই। নিজেকে আংরেজি ছবির নায়ক নায়ক মনে করতে লাগলাম।

হাতমুখ ধুতে ধুতে কফি চলে আসলো। আসিফ এবং রাফি বিভিন্ন গঠনমূলক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো। আমি কফি খেয়ে নেমে গেলাম নীচে,মেইল করতে।
মোস্তফা গেমস খেলার মতো বক্স কম্পুটার। ৩০ মিনিট পর পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেট বিচ্ছন্ন হয়ে যায়। মেইল বক্সে আমাদের সাথের আরেক ছাত্র প্রত্যয় এর প্রেমিকার একটি মেইল পেলাম,রমণী প্রেমিকের জন্য খুব টেনশন করছে।

 পিতা মহাদয়কে মেইল দিলাম,যে হোটেলে আছি,কোন সমস্যা নাই। ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম

- হ্যাভিং ফান উইথ ফ্রেন্ডযযয( এস নয় বরং ইংরেজি জেড দিয়ে লিখতে হবে) ইন আবুধাবী এয়ারপোর্ট হোটেল..... .
এই ধরনের স্ট্যাটাসকে বলা হয় চিল বা কুল আপডেট।  এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষনীয়। “ফ্রেন্ডয” লেখার মানে হোল আমার অনেক বন্ধু এবং সেখানে মেয়ে বন্ধুও আছে। দ্বিতীয় বিষয় লাইনের শেষে ডট ডট ডট...... অর্থাৎ ফান চলছে,এবং   ফান যেকোন দিকে টার্ন করতে পারে।

নিজেকে কুল ডুড প্রমান করে আমি এয়ারপোর্ট এর মধ্যের দোকান পাট ঘুরে দেখতে লাগলাম,ক্যামেরার দাম খুব কম,গয়না গাটিরও,চকলেটের। অনেক শেখ দেখলাম,ঢোলা আলখাল্লা পরে মাথায় পাগড়ী বেঁধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। এছাড়াও নেপালের দুজন ছাত্রের সাথে পরিচয় হোল, তারা হোটেল বুক করেনি,তাই সারা রাত লবিতে বসে কাটাতে হবে,আমার সাথে খাতির জমাতে এলে আমি পাত্তাই দিলাম না,কারন তারা লবিতে রাত কাটাবে আর আমি হোটেলে। কিছু উপদেশ দিয়ে আমি সটকে পড়লাম। কারন নাপিত যখন মন্ত্রী হয়,তখন সে আর, নাপিত কি জিনিস চেনে না এবং চেনার চেষ্টাও করে না। এটাই স্বাভাবিক।

রাত আটটার দিকে ফিরে এলাম রুমে। গঠনমূলক আলোচনা তখনও চলছে,আমি তাদেরকে বললাম যে প্রত্যয় এর প্রেমিকা আমাকে মেইল করেছে,সবার চোখে সন্দিহান জিজ্ঞাসু। প্রত্যয়কে না করে আমাকে কেন? আমিও এক দাগ বেশি রহস্য চোখে নিয়ে বুঝিয়ে দিলাম আমাকে নয় তো কি তোমাদের মতো ফাতরাদের মেইল করবে? আমি সবাইকে বললাম যে এখন বুফেতে না গেলে মানুষের খেয়ে ফেলা উচ্ছিষ্ট খেতে হবে শেষে। সবাই তড়িঘড়ি করে তৈরি হয়ে গেল।

আমি নক করলাম মেয়েদের রুমে। বেড়িয়ে এল যে মেয়েটি সে বড়ই রূপবতী হয়েছে,ভেজা চুল,ঠোঁটে লিপগ্লস, কুসুম কুসুম রোমান্সের ইচ্ছা বাড়ি দিল মনে ভীষণভাবে। রাতে খেতে যাবার কথা বললাম,এবং কেয়ারিং হবার চেষ্টা করলাম। এটা সেটা জিজ্ঞাসা করলাম,কোন সমস্যা হয়েছে কিনা, শরীর কেমন,এসিতে তাপমাত্রা ঠিক মতো সেট করতে পেরেছে কিনা ইত্যাদি। আমি তাকে বুঝিয়ে দিলাম- ইফ সি নিডস এনিথিং,আই এম অলঅয়েজ দেয়ার,বাই হার সাইড।
জুটিকেও জানতে সাহায্য করলাম কোথায় বুফে,এবং কিভাবে যেতে হবে।

দলবল নিয়ে আমরা বুফেতে পৌঁছে গেলাম এবং বাঙ্গালীয়ানা বজায় রেখে টেবিলে এক্সট্রা চেয়ার যোগ করে সবাই একসাথে বসলাম। নাম বুফে হলেও ওয়েটার আছে এবং তার চেহারায় উপমহাদেশীয় ছাপ। ওয়েটার কাছে আসতেই মেয়েটি বলে উঠল “ টাকলা ওয়েটার” আমরা সবাই একচোট হেসে নিলাম। মেইন কোর্স অর্ডার করল যে যার পছন্দ মতো। তবে সবাই খুটিয়ে দেখে নিল পর্ক আছে কিনা,আমি সবাইকে নিশ্চিত করলাম যে আরব দেশের এয়ারপোর্ট হোটেলে পর্ক এবং এলকোহল থাকবে না এবং তার মধ্যে এখন রোজা চলছে।

শুয়োরের বিষয়টি দেশের বাইরে খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়। না খেয়ে মরে গেলেও শুয়োর ছোয়া চলবে না। শুয়োরকে যত গাল পাড়বেন আপনার উপর প্রবাসীরা তত খুশী হবে। এছাড়াও রাশিয়াতে আরব ছাত্রদের দেখেছি মদের সাথে খাবার জন্য গ্রাম থেকে হালাল ভেড়া অথবা গরুর মাংস কিনে আনতে,শুয়ার কখনই নয়। শুয়োর খাওয়া ইসলামে সরাসরি হারাম। আমরা অপেক্ষা করছি খাওয়া আসার,এর মধ্যেই আমাদের জুটি পৌঁছে গেল,আমাদের কোন রকম পাত্তা না দিয়ে তারা আলাদা টেবিলে বসে গেল এবং খুনসুটি করতে লাগলো।

খাবার আসার পর দেখ গেল কেউই খেতে পারছে না,কেউ কাটা চামচ চাকুর জন্য,কেউ লজ্জায়,কেউ ভাত- মাছ না পেয়ে। সবাই তখনও চামচে টুং টাং করছে আমি ওয়েটারকে ডেকে ডেসার্ট অর্ডার করলাম, ফ্রুট কেক চাইলাম।

কেক চলে আসার পর দেখা গেল উপরে অজানা এক ফলের টুকরো। আমি সম্ভ্রান্ত মুসলমানের ঘরের সন্তান,না জেনে কিভাবে খাই? যদি হারাম ফল হয়? আমি আমার ওয়েটারকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম এই ফল কি ফল? সে জবাব দিল “কিভি” কিভি হোল বাংলাদেশে আমড়া সাইয ফল,ছিলে খেতে হয়,টক মিষ্টি স্বাদ। ভেতরের শাঁসের রং কাচা কলার মতো। আগ্রহীদের জন্য কিভি ফলের একটা ছবি দিয়েছি। পিচ ফল আর কিভি ফল এখনও আমার সবচে প্রিয় ফল।
কেক শেষ হবার পর আমি আইসক্রিম নিতে চাইলাম,ওয়েটার বলল
- স্যার ইউ হ্যাভ অলরেডী অর্ডারড ইয়োর ডেসার্ট,ইউ ক্যান নট অর্ডার এগেন।

ইজ্জতের পায়জামা খুলে গাছে ঝুলিয়ে দিয়ে গেল ব্যাটা। জুমার নামাজের দুই রাকাত ফরজ নামাযের জামাতের পর আপনি মসজিদে প্রবেশ করলে আপনার দিকে মানুষ যেভাবে তাকিয়ে থাকে,সবাই আমার দিকে সেইভাবে তাকিয়ে রইল।
আমি হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু বিষয়টা ঠিক উড়ল না।

পেটপূজা সেরে আমরা রুমে ফিরে আসলাম। সবাই আমার রুমে বসল,বিভিন্ন গল্প গুজব করছি,কে কিভাবে এপ্লাই করেছে,কার বাড়ি কই,ভাই বোন কতজন,কে কয়টা প্রেম করেছে ইত্যাদি। আমি হাই তুলে বললাম- এক প্যাকেট তাস নিয়ে আসা উচিত ছিল,২৯ খেলা যেত,সবাই আমার দিকে এমনভাবে তাকালো যেন আমি সবাইকে হেমলক বিষ খেতে বলেছি।

মেয়েটি বিদায় নিল,তার নাকি ঘুম আসছে। এরপর আমি প্রস্তাব দিলাম সবাইকে,নীচে যাওয়া যাক,অনেক নারী যাত্রী আছে,পরিচিত হওয়া যাক,কথা বলা যাক আফটার অল দেয়ার ইজ আ থিং কল্ড “ ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড” কিন্তু সবার অনাগ্রহ দেখে মনে হোল আমি একদল সমকামীর মাঝে এসে পড়েছি।

একজন প্রস্তাব দিল গানের কলি খেলা যায়। আমি একটা সিধান্তে পৌঁছে গেলাম,হয় আমি ভিন গ্রহের বাসিন্দা,নয়ত এরা ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা।
সহসা রুমের ফোন বেজে উঠল,সবাই একযোগে আমার দিকে তাকালো। আমি উঠে গিয়ে ফোন ধরলাম। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হোল কেউ রোজা রাখবে কিনা? তাহলে ভোররাতে ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়া হবে ফোন করে,এবং খাবারের ব্যবস্থা আছে। আমি বললাম অবশ্যই,আমরা সবাই রোজদার।

ফোন রাখার পর সবাই জিজ্ঞাসা করল আমি কেন হ্যাঁ বললাম,আমি তো গতকালও রোজা ছিলাম না,তাছাড়া,আমরা কোথায় ইফতারী করব? মস্কো পৌঁছে আমাদের ইফতারের ব্যবস্থা কে করবে?
আমি সোজা সাপটা বলে দিলাম যে আমাদের প্রিয় নবীজী( দঃ) সবসময় সেহরী খেয়েছেন,এবং সাহাবীদের সেহরী খাবার জন্য উৎসাহিত করেছেন,আমি সেহরী এবং ইফতার ছেড়ে দিয়ে পাপের ভাগীদার হতে চাইনা।

এরপর যে যার রুমে চলে গেল,সিধান্ত হোল,যার ইচ্ছা সে খাবে,যার ইচ্ছা না সে সেহরী খেতে যাবে না।
( চলবে)

Sunday 26 August 2012

সবাই যায় পশ্চিমে,আমি গেলাম পুবে ও পশ্চিমে (১)


আজ আমার প্রবাস জীবনের ৩ বছর পার হয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালের এই দিনে বাক্স পেটরা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। আমার মা হাপুস নয়নে কান্না কাটি করছিলেন,সাথে যোগ্য সঙ্গ দিচ্ছেন আমার বড় ফুপি। আমি দুজনের কাছ থেকে একটু আড়ালে থাকছি,কারন কান্না বিষয়টা বমির মতো,দেখলেই পেয়ে যায়।

পকেটে কিছু বাংলাদেশী টাকা ছিল, ভাগ করে দিয়ে দিলাম আমার ছোট ভাইকে আর ফুপাতো ভাইকে। আমার বাবা আমাকে বিভিন্ন উপদেশ দিতে লাগলেন। কিভাবে সাথে থাকা ডলার এবং সুটকেস নিরাপদে রাখতে হবে,বিপদে পড়লে কি করতে হবে,সুটকেস মিসিং হয়ে গেলে কি করতে হবে এইসব।

আমার সাথে আরো যাচ্ছে ৬ জন সরকারী স্কলারশীপ প্রাপ্ত ছাত্র এবং দুইজন ছাত্রী। সবাই বেশ কান্নাকাটি করছে,একজনের দেখলাম প্রেমিকাও এসেছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চেক ইনে দাঁড়ালাম। একজন ছাত্রী আমার সাথে পরিচত হবার চেষ্টা করল,নাম ধাম, বাড়ি কোথায় ইত্যাদি। আমি সযত্নে উত্তর করে এড়িয়ে গেলাম,কারন সামনে দীর্ঘ পথ,আবু ধাবী তারপর মস্কো। অতিরিক্ত খাতিরের ফলাফলে আমার ঘাড়ে তার বাক্স পেটরা উঠিয়ে দেবার সম্ভাবনাই ৯০ ভাগ। অতএব যাত্রাপথে আমি কুসুম কুসুম রোমান্সের আশা পরিত্যাগ করলাম।

সেই রমণী আর আমি এখন একই শহরে পড়াশুনা করি,আশা করি রমণীর চোখে এ লেখাও পড়বে,এবং রমনী এই অধম রমনকে মাফ করিয়া দেবে।

বাক্স পেটরা প্লেন কোম্পানীকে গছিয়ে দিয়ে ইমিগ্রেশনের লাইনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সামনে সুইডেন গামী একদল শ্রমিক ভাই,তাদের গায়ে একই রঙের গেঞ্জি,মাথায় একই রঙের ক্যাপ। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম,তারা একই কোম্পানীতে চাকরী করতে যাচ্ছে। ইমিগ্রেশনে যাতে ঝামেলা না হয় এই জন্য ট্র্যাভেল এজেন্সি থেকে এই কাপড় পরিয়ে দিয়েছে,আরো জানতে পারলাম ভিসা লাগাতে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে মাথা পিছু। শ্রমিক ভাইদের বিদায়ের পর আমার পালা।

ডেস্কে বসা পুলিশ আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করল,মস্কো যাচ্ছি শুনে তার পরিচিত এক আত্মীয়ের নাম এবং ফোন নাম্বার আমাকে লিখে দিল। আমিও বিনয় প্রদর্শনে কার্পন্য করিনি একফোটা। বাত-চিত শেষে আমার পাসপোর্ট মিলিয়ে দেখার পালা,কম্পুটারে নাম্বার ঢুকাতেই বিদ্যুৎ চলে গেল,মেজাজ গরম করে অফিসার আমাকে সিল ছাপ্পড় মেরে দিল কারন ব্যাক আপ জেনারেটর চালু হতে হতে ৩ মিনিট লাগে,আর সিস্টেম রিস্টোর হতে আরও ৪-৫ মিনিট। এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করার মতো বাজে সময় অফিসারের হাতে নেই। আমি মনে মনে ভাবলাম বাহ! আমি যদি আজ সাজাপ্রাপ্ত ফেরারী আসামীও হতাম,পার হয়ে যেতাম নিশ্চিন্তে।

এয়ারপোর্টের ভিতরে কিছু খাবারের দোকান আছে,সেখানে ১০ টাকা দামের মাম পানির বোতলের দাম ৭০ টাকা, বনরুটি সাইয বার্গারের দাম ৩৬০ টাকা,রোল পরোটা ৩৫০ টাকা ইত্যাদি।
আমি জীবনে প্রথমবারের মতো ডিউটি ফ্রি মার্কেট দর্শন করে ভীষণ হতাশ হলাম। কুকুরের পেটে ঘি সয় না,আর গরীবের গায়ে এসি সয় না। ভিতরের শীতল বাতাসে আমার ভীষণ শীত শীত করতে লাগলো। বসার জন্য সুন্দর জায়গা আছে,সেখানে নানা কিসিমের মানুষের ভিড়,বেশির ভাগই শ্রমিক ভাইয়েরা। আর একটু উচু দরের যাত্রীরা নিজেদের আলাদা বলয় সৃষ্টি করেছে, সেখানে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করছে,বেশির ভাগ কথাই বলছে ইংরেজিতে, যেখানে আটকে যাচ্ছে সেখানে বাংলা।

উড়োজাহাজের পেটে চাপিয়া বসিলাম। একপাশে এক মস্কোগামী এক ছাত্র অন্যপাশে অপরিচিত এক ভদ্রলোক,বাইরে গুড়ি গুড়ি বৃস্টি,মনের মধ্যেও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। মায়ের সাথে কথা বলছিলাম সেল ফোনে। অসম্ভব রূপবতী এক রমনী এসে বলল
- স্যার প্লিজ টার্ন অফ ইউর ইলেকট্রনিক ডিভাইসেস।
ভাগ্যিস স্কুল কলেজে ১২ বছর আংরেজি শিখেছিলাম নয়ত যাত্রাপথে বহু সমস্যা হয়। গোঁদের উপর বিষফোঁড়া,তখন চলছিল রোজা। প্লেনের অধিকাংশ যাত্রী ওমরা হজ করতে যাচ্ছে। আমার ধারনা ছিল শুধু মাননীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াই ওমরা হজ করেন,বিশাল হজ বহর দেখে ভুল ভাঙল।

উড়োজাহাজ আকাশে ডানা মেলার সাথে সাথে যাত্রীদের খচর মচর শুরু হয়ে গেল,বোম্বে চানাচুর,বন রুটি,কলা কিছুই বাদ থাকলো না। এবং খাবার পর অনায়াসে প্যাকেটগুলো ঝড়ে পড়তে লাগলো প্লেনের মেঝেতে।

আমি সোজা বোতাম টিপে ভদকা আর কোকের অর্ডার করলাম,ফ্রি প্রিমিয়াম এলকোহল যতদূর কনজিউম করা যায় ততখানিই লাভ,এই ছিল দর্শন। বাঙ্গালী ফ্রি পেলে শাদা লুঙ্গিতে আলকাতরা তুলে নেয় আর সেখানে এলকোহোল। কোথায় আগরতলা কোথায় খাটের তলা।

পাশের যাত্রীরা আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল। এসব চক্ষু উপেক্ষা করা প্রথমে প্রথমে একটু কষ্টকর।
ঘণ্টা খানেক পর এক ওমরা যাত্রী এয়ার হোস্টেসকে ডেকে নিয়ে হজ এর শানে-নুজুল,সওয়াব ইত্যাদি বুঝিয়ে বলছিলেন। রমনীর গরু চোখ দেখে আমার পেটের মধ্যে হাসি গড়িয়ে গেল,এক অক্ষর বুঝতে পারছিল না রমণী। নিজের ইংরেজি দক্ষতার প্রদর্শনী দেখিয়ে আমি অনুবাদ করে দিলাম মূল অংশ।

এরপর খাবার পালা,সাটিয়ে বসলাম তাছাড়া আমার মৃদু এলকোহলের পর খাবার রুচি বাড়ে। যা খাবার দিল,সেই রকম খাবার তিন বার চালালেও আমার পেটের আধা ভরবে না।
খাবার পর চা/ কফির আয়োজন। আমি এসব ছেড়ে রেড ওয়াইন চেয়ে বসলাম। আমার কাণ্ড কারখানায় সাথে ছাত্র ছাত্রীরা খুবই বিরক্ত,পারলে প্লেন থেকে নেমে পরের প্লেনে আসে এমন অবস্থা। অথবা ফোন করে আমার বাপের কাছে নালিশ দেয়।

দামী বিমান বলে কথা, সেখানে মিউজিক শোনা এবং মুভি দেখার বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে দুইএকজন কানে হেডফোন লাগিয়ে রক মিউজিক শুনতে লাগলো এবং মাথা সামনে পেছনে দোলাতে লাগলো। এই গান শোনা পার্টি আমার খুবই বিরক্ত লাগে,আমি বিশ্বাস করি কণ্ঠ আছে অতএব গান শুনলে নিজের গলায়। এদের কাজ কারবার দেখলে মনে হয় মায়ের পেট থেকে পড়েই রক মিউজিক শোনা শুরু করেছে,ওয়াইন শেষ করে আমি কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে নিলাম তখন দেখি মুসুল্লী পার্টী প্লেনের খাবার প্যাকেটে ভরছে,কারন তারা রোজা। এই নাহয় বাঙ্গালী,নামে যেমন কাজেও তেমন।

৬ ঘণ্টা ওড়ার পর নামার সময় হয়ে এল,নামার সময় তলপেটে অদ্ভুত এক চাপ অনুভুত হয়,যেই সেই না একদম বেশ ভালো একটা চাপ। সহিহ সালামতে নেমে আসলাম আবুধাবী বিমান বন্দরে। চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি।

আবু ধাবীতে আমাদের ২৩ ঘন্টার যাত্রাবিরতি। চেকিং এর আনুষ্ঠানিকতা সেরে পৌঁছে গেলাম বিমান অফিসের ডেস্কে। উল্লেখ্য এই যে, সব জায়গায় কথা বার্তা আমিই চালিয়েছি,হাজার হোক গত ৫ বছরের আংরেজি মিডিয়ামে পড়বার অভিজ্ঞতা বলে কথা। তবে ইদানীং ফেশবুকে যেভাবে ইংরেজি চর্চা হচ্ছে তাতে মাঝে মাঝে বড় দোটানায় পড়ে যাই। আসলে কোনটা সহি আংরেজি? যেটা স্কুল কলেজে শিখেছি নাকি যেটা কুল ডুডসরা লেখে সেটা?

এয়ারপোর্ট হোটেলের কার্ড নিয়ে হোটেল রুমে চলে এলাম,সেখানে এক রাত থাকার আয়োজন এবং ৪ বেলা খাবার আয়োজন করা হয়েছে। চাবি ছাড়া তালা দেখলাম সেই প্রথম,খোপের মধ্যে কার্ড ভরে দিলে দরজা খুলে যাচ্ছে,আহা সে যেন জাদুর বাক্স। ভিতরে আর একটা স্লট,সেখানে কার্ড সেট করলে বিদ্যুৎ সংযোগ। চমৎকার সাধু। অর্থাৎ কেউ রুম থেকে বেড়িয়ে গেলে বিদ্যুৎ অপচয় হবার কোন সম্ভাবনা নেই। সরকারী অফিস আদালতে এই সিস্টেম করলেও পারে।
এছাড়াও রুমে ঢুকেই এসির রিমোট হাতে নিয়ে একটা নাতিশীতোষ্ণ টেমপেরেচার সেট করে বাকি সবাইকে দেখিয়ে দিলাম যে আমি নিতান্ত ফেলনা নই। প্রতি রুমে দুইজন করে মোট ৪ রুম দেয়া হোল আমাদের।

আমার সাথের ছেলেটা একটু আড়ষ্ট বোধ করতে লাগলো,সে বিছানায় চুপচাপ বসে রইল। আমি তার সামনেই কাপড় চোপড় খুলে গোসল করতে ঢুকে গেলাম,তার চক্ষু কপালে,অবশ্য আমার দোষ না,আমার হ্যান্ড লাগেজে কোন কাপড় ছিল না। আমি নিরুপায়। বাথটবে ঘণ্টা খানেক দাপাদাপি করে ফিরে এসে দেখি ছেলেটা সেই একই জায়গায় চুপচাপ বসে আছে। বললাম গোসল করতে যেতে,না বোধক মাথা নাড়ল সে। আমি চুপচাপ টিভি ছাড়লাম,বোরিং আরাবিক চ্যানেল দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে গেলাম।
( চলবে)

Wednesday 22 August 2012

বাঁচুক সবাই মানুষ হয়ে


সদরঘাট,ঢাকা

সকালে ঘুম থেকে জেগেই কোন কাজ না করার সিধান্ত পাকা করে ফেলল মহসিন। আশে পাশে কেউ নেই,আগোছালো কাঁথা,বালিশ স্তূপ হয়ে রয়েছে। মহসিনের পাশে যারা ঘুমায় তারা বেশিরভাগই রিক্সা চালায়,সাত সকালে উঠেই কাজে চলে যায়। ঢাকা শহরে মনে হয় কম খরচে এর থেকে ভালো ঘুমানোর ব্যবস্থা আর নেই। বুড়িগঙ্গা নদীর উপর কাঠের লম্বা ঘর,উপরে টিনের চালা,রাত প্রতি ২০ টাকা,কাঁথা বালিশ বিছানোই থাকে,টাকা দিয়ে ঢুকে শুয়ে পড়লেই হয়। তবে মালিক গত মাসে বলে গিয়েছে আগামী মাস থেকে ৩০ টাকা রেট। আপাতত এ নিয়ে ভাবছে না মহসিন।

মোট তিন রকমের কাজ করে মহসিন,সপ্তাহে তিন দিন ময়লার গাড়ি নিয়ে ময়লা সংগ্রহ করে বাড়ি বাড়ি,বাকি তিন দিন ভ্যানে সবজিবিক্রেতা কমলের সাথে সবজি বিক্রি করে,আর বাকি একদিন কিছুই করে না,ঘুরে বেড়ায়। ইচ্ছে হলে রাতে রাতে স্বর্ণকারদের দোকানের পাশের ড্রেন থেকে ময়লা তুলে এনে পানিতে পরিষ্কার করে। মাঝে মাঝে সেই ময়লার মাঝেও মেলে এক দুই দানা সোনা, দিনে সেই একদানা সোনা আবার স্বর্ণকারদের কাছেই বিক্রি করে। তবে রাতে সোনার দানা পাবার সম্ভবনা খুব কম থাকে,কারন দোকানের ময়লা ফেলা হয় বিকেলে,সন্ধ্যার পর ময়লা ফেললে নাকি অমঙ্গল হয় ব্যবসার। যেদিন এক দুই দানা সোনা মেলে সেদিন একটু ভালো যায় মহসিনের,২০০-৩০০ কাঁচা টাকা আসে পকেটে,সেই সব দিন গুলোতে সিনেমা দেখতে যায় মহসিন,সন্ধ্যার শো। সিনেমা দেখে বের হয়ে একটা কুলফি মালাইও খায়। মালাই চাটতে চাটতে লোকাল বাসে করে ফিরে আসে বুড়িগঙ্গার পাড়ে।

 তবে কয়লা দিয়ে ভালো ছবি আঁকতে পারে মহসিন,খয়েরি রঙের কাগজের উপর একবার একটা ছবি একেছিল সে,প্রিয় নায়িকা শাবনুরের ছবি। সেই ছবি লুকিয়ে রেখেছিল বেগুনের ঝুড়ির নীচে। বেগুন কিনতে এসে এক রমণী সেই ছবি দেখে ফেলে,বাধ্য হয়ে স্বীকার করতে হয় মহসিনের যে ছবিটি তারই আকা

আসমানী- এই ছেলে,এই ছবি তুমি এঁকেছ?
মহসিন- জি আফা।
- তুমি সবসময় ছবি আঁক?
- জি না আফা।
- একটা ছবি দিলে দেখে আঁকতে পারবে?
- কার ছবি আফা?
- আমার একজন প্রিয় মানুষের।
- পারমু আফা।

আসমানী তাকে সুদর্শন এক রমনের ছবি ধরিয়ে দিল। সাথে দিল ৩৫০ টাকা। ছবি আঁকতে হবে কাপড়ের উপর,যেই সেই কাপড় না,মোটা কাপড়ের উপরে। এই ছবি প্রিয় মানুষকে উপহার দেবে আসমানী। মোটা কাপড় কিনে বুড়িগঙ্গার সেই চালা ঘরে ছবি আঁকতে বসেছিল মহসিন। রাতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গিয়েছিল,একজন এক কাপ চাও এনে দিয়েছিল,কয়েকজন বিড়ি নিয়ে বসে গিয়েছিল গল্প করতে, একজন বলেছিল একটা ন্যাংটা মেয়ের ছবি আঁকতে,বাকিরা তাতে সায়ও দিয়েছিল।

তিনদিন পর ছবি নিয়ে গিয়েছিল মহসিন। ছবি আর কাপড় কেনার পর বাকি ৯০ টাকা ফেরত দিয়েছিল আসমানীকে। আসমানী মিষ্টি হেসে তাকে আরো ৩০০ টাকা ধরিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে। সেদিন শাকিব খান-অপু বিশ্বাস এর একটা ছবি দেখেছিল মহসিন,ছবির পর এক হোটেলে ঢুকেছিল নান রুটি আর সবজি খেতে,হোটেল থেকে বের করে দিয়েছিল মহসিনকে,ময়লা কাপড়ে নাকি এসব জায়গায় ঢোকা যায়না।

পড়াশুনা করতে পারেনি সেই অর্থে মহসিন, সিডরে সব ভেসে যাবার পর ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছিল,ভাগ্য তো ফেরেনি,বেড়েছে দুর্দশা,কখনও এক পেট খেয়েছিল,কখনও আধাপেটা,পার্কে ঘুমিয়েছে,রেল স্টেশনে,হিরোইন খোর সন্দেহে একবার জেলেও ছিল একরাত। জীবন যেখানে যেমন। তবে আক্ষেপ নেই মহসিনের। সবাই যদি গাড়ি ঘোড়া চড়তে শুরু করে,সবাই যদি শিক্ষিত হয়ে যায়,সবাই যদি ভদ্দরলোক হয়ে যায় তখন তো আর দুনিয়া চলবে না। তাছাড়া সবাই ভদ্দরলোক নাকি,ভদ্দরলোক নামী বহু খারাপ মানুষও আছে,শার্ট প্যান্ট পরা অনেকেই তো সদরঘাট আসে হেরোইন কিনতে,কত বিবাহিত ভদ্দরলোকের আছে আলু-পিয়াজের দোষ। এর থেকে মহসিনের ময়লা মাখানো জীবনটা বহু ভালো আছে। ময়লার মধ্যে থেকেও,ময়লা ঘেটেও মনটা রেখেছে পরিষ্কার। আলু-পিয়াজের দোষও নেই,নেই কোন মাদকাসক্তি।

শার্ট চাপিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এল মহসিন। রাস্তার কলের পানিতে হাতমুখ ধুয়ে নিল,বড় রাস্তায় উঠে বাম দিকের বাড়িতে একটা প্লাকার্ড দেখতে পেল মহসিন,সেখানে লেখা “ আজ শুভর জন্মদিন”  নিজের জন্মদিন কবে মনে করতে পারলো না মহসিন,স্কুলে ভর্তি হবার সময় মাস্টার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “ মহসিনের জন্ম তারিখ কবে?”
মা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন “ মাস্টার সাব,তারিখ তো মনে নাই,তয় তালের সময় হইছিল মহসিন”
মাস্টার বাধ্য হয়ে মনমতো একটা জন্মতারিখ বসিয়ে দিয়েছিলেন। ঝামেলার কথা হোল সেই মনগড়া তারিখটাও মহসিনের মনে নেই। হুট করে আরো একটা সিধান্ত নিয়ে নিল মহসিন,আজই তার জন্মদিন। আজই সে পালন করবে জন্মদিন।

মোড়ের হোটেলে ঢুকেই,সুপ,পরাটা আর চায়ের অর্ডার করল মহসিন,জন্মদিনে ভালো মন্দ না খেলে উপরঅলাও রাগ করবেন। খাওয়া শেষ করে পাশের স্টেশনারী দোকানে ঢুকলো
- ভাই কেক আছে?
- কেমন কেক?
- গায়ে মেখে গোসল করার কেক
- ফাইজলামী করিস?
- তাইলে কেক আবার কেমন হয়? খাওয়ারই তো হয় নাকি?
-কয় পিস?
- এক পিস
- ১০ টাকা দে।

 কেক মুখে দিয়ে নিজের জন্মদিন পালন করল মহসিন,বিচ্ছিরি কেক,সস্তার তিন অবস্থা,চিনি আর ডালডা, দুনিয়াটা ভেজালে ভরে গেল ভাবতে ভাবতে কেক ছুঁড়ে ফেলে দেয় মহসিন। জন্মদিনে যদি একটুকরো কেকই না খাওয়া গেল।

একটা ফোন ফ্লেক্সীলোড এর দোকানে ঢোকে মহসিন,কাউকে ফোন করে জেনে নিতে হবে কোথায় আছে ভালো কেক,একপিস কেক না খেলেই নয়।
ফোন সামনে নিয়ে বসে আছে এক তালপাতার সেপাই,এর মধ্যে আবার সে খানদাণী গোফ রেখেছে,দেখেই হাসি পেয়ে গেল মহসিনের। ¬
- একটা ফোন করবার চাই।
- কাকে?
- আপনার বউরে
- বেয়াদ্দপের বাচ্চা,থাপড়াইয়া কানসা লাল করে দিমু।
- আপনেই তো জিজ্ঞাসা করলেন,আপনার কি দরকার আমি কারে ফোন করি? কথা কমু পয়সা দিমু।
- নে ফকিরনীর বাচ্চা

মোবাইলটা বেশ বাহারী। উপরে আবার প্লাসটিকের কাভার লাগানো। কাভারটা এই মোটা, যেন মোবাইলের গায়েও রাশিয়ার বরফ ঠাণ্ডা লাগে। মোবাইলের গায়ে আবার শেকল বাধা,শেকলের আরেক মাথা বাধা দোকানদারের টেবিলের সাথে। কিন্তু এখন ঝামেলা হোল,কারো মোবাইল নাম্বারই সে জানে না। কাকে ফোন করবে সে মহসিন? মনে পড়ল আসমানী তাকে একটা কাগজে করে নাম্বার দিয়েছিল,মানিব্যাগ হাতড়ে কাগজটা বের করল,নাম্বার লিখে ফোন করল
- হ্যালো
- হ্যালো আফা সালাম
- কে বলছেন?
- আফা আমি মহসিন
- সবজি মহসিন?
- জি আফা
-কেমন আছো? কোথা থেকে ফোন করেছ?
- আফা সদর ঘাট, আমি এইখানেই থাকি।
- আমাদের এখানে কবে আসবে সবজি বেচতে?
- পরশু,আফা আজকে আমার জন্মদিন,এক পিস কেক খাইতে ইচ্ছে করতেছে,কম দামে কই পামু?
- ওমা,তাই নাকি? তুমি চলে এসো আমাদের এলাকায়,এখানে এসে ফোন দাও,আমি নিয়ে যাবো তোমাকে দোকানে,আজকে আমি তোমাকে খাওয়াবো।
- না থাক,আফা,ঝামেলা করনের দরকার নাই,আমি খুজে নিবনে। আপনি খালি বলেন
- আরে ধুর চলে আসো। আমি বলেছি না আসতে।
- আচ্ছা ঠিকাছে আফা
- কিন্তু কিভাবে আসবে? আজকে তো হরতাল।
- কি যে বলেন আফা,এইডা কোন ঘটনা? আমি একটা ব্যবস্থা করে চলে আসবো।
- আচ্ছা তাহলে।

ফোনের বিল মিটিয়ে বের হয়ে আসে মহসিন,একটা রিক্সা করে লালবাগ এর মোড়ে এসে নামলো। এখান থেকে অন্য রিক্সা নিতে হবে,রাস্তা ঘাট একদম ফাঁকা, রিক্সা ছাড়া আর কোন যানবাহন নেই। হাঁটতে হাঁটতে রিক্সা খোজার সিধান্ত নেয় মহসিন।

 সামনে মিছিল দেখা যাচ্ছে,রাস্তার একদম পাশ ঘেঁটে হাটতে থাকে মহসিন,মিছিলের ক্যাচালে পড়বার কোন ইচ্ছা তার নাই, বিপরীত দিকে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়েছে,মিছিলের মধ্যে বিদ্রোহের দানা গুটি বাধলো,উৎসাহী কয়েকজন পিছনে টায়ারে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়েছে,একদম বলা নেই কওয়া নেই কয়েকজন ইট ছুড়তে লাগলো,পুলিশ প্রথমে কাদুনে গ্যাসের শেল ছুড়ল,শেল ফাটলো মহসিনের ঠিক পাশে,প্রচণ্ড ধোয়াতে চোখ জ্বলতে লাগলো মহসিনের,এর পর রাবার বুলেট,ছিঁড়ে যেতে চাইল মহসিনের পা,ধোয়াতে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারল না মহসিন,তবে অনুভব করল গরম পানির স্রোত বইছে পা থেকে নীচে।

 শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগলো মহসিনের,কিন্তু না এখানেই যদি থেমে যায় মহসিন,হাজারো পায়ের নীচে চাপা পরে মৃত্যু হবে মহসিনের। আহত পা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আরো সামনে এগিয়ে গেল মহসিন,সেখানে দুটো দোকান দেখা যাচ্ছে। দুটো দোকানের ফাঁকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল মহসিন। একটু জিরিয়ে নিয়ে সামনে বাড়তে হবে,ধরা পরা যাবে না পুলিশের হাতে,ধরা পড়লে জেলে চালান করে দেবে,বলবে এরাই মিছিল থেকে বোমা ফাটিয়েছে।
সব কিছু ভেঙে পড়তে থাকে মহসিনের,চোখের সামনে ভেসে ওঠে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া সিডর এর পানির তোড়,কানে আসতে থাকে আসমানী এর গলা, নাহ জ্ঞান হারানো চলবে না,কিছুতেই না।

এই বাংলাদেশে মহসিনদের কেউ উদ্ধার করে না,কেউ চিকিৎসা করায় না,কেউ বিশ্বাস করে না। মহসিনদের দল নেই,জাত নেই,পাত নেই তবু মহসিনেরা জেলে চালান হয় স্রোতের মতো,মহসিনদের উদ্ধার করার কেউ নেই।
মহসিনদের উকিল নেই,ক্ষমতা নেই,গদিতে বসার আকাঙ্খা নেই,পয়সা নেই,পয়সার কামনা নেই তবু কেন যেন এই বাংলাদেশে মহসিনেরা ভোগে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ,উলুখাগড়ার প্রানান্ত।

শার্ট ছিঁড়ে পা বেঁধে ফেলে মহসিন,এইতো একটু ভালো লাগছে তার। সামনের দিকে এগিয়ে চলে মহসিন। কে জানে তার মতো আরো কত মহসিন চলছে হাতড়ে হাতড়ে,বেঁচে থাকতে,একটু ভালো থাকতে,ভাগ্য ফেরাতে।

( লেখাটি পুলিশী অত্যাচারে নির্মমভাবে পা হারানো লিমনকে উৎসর্গ করছি,লিমনের মতো কেউ অমানবতার ছাপ না বয়ে চলুক। সবাই বাঁচুক মানুষ হয়ে মানুষের মতো। )

Saturday 11 August 2012


 মহুয়ার বনে সঙ্গম
- তাওসীফ হামীম ও শর্মী আমিন


মহুয়া বনে যাবে আমার সাথে?
কেড়ে নেব তোমার নগ্নতা আর লজ্জা
শীৎকারে শীৎকারে,শব্দের প্রতিধ্বনিতে বন উতলা হবে
উতলা হোক দুটি তনু

যদি শীতল চাঁদ নিজেকে লুকোয় মেঘের ঢালে
আলোতে বড্ড নির্লজ্জ লাগে

নির্লজ্জতাকে ঝেড়ে ফেলে ঝাঁপিয়ে পড় সেই আলোতে
কুরে কুরে খাও মেঘ মাখানো চাঁদের আলো
একদম শেষটুকু পর্জন্ত

মহুয়াতে আকন্ঠ নিমজ্জিত হব তবে
বাকিটুকু না হয় তুমি কোরো
ফেনিল জোছনা সূক্ষ্ম মশারি হয়ে আবৃত করবে নগ্ন দেহ

মশারীর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফাকা ভেদ করে আমার কামনার জিহ্বা শুষে নেবে তোমার নারী সুলভ গন্ধ
ছড়িয়ে দেবে কামনার আবেশের এনথারক্স
তোমার শরীরের প্রতিটি কোষপ্রাচীর ভেদ করে পৌঁছে যেতে চাই গহীন থেকে গহীনে

উন্মুক্ত করে দিলাম নিজেকে
ব্রীড়ার ভাঁজ খুলে ডেকে নিলাম প্রবল পুরুষকে
মথিত আবেশে শিহরিত শরীর
নিষিদ্ধ প্রেমে উন্মত্ত যুগল

তোমার বুকের ঘামেও মৃগীর গন্ধের ছড়াছড়ি
সরু বাহুতে মরুভুমির মসৃণতা
কটিদেশে তোমার সমুদ্র ঢেউয়ের উদ্দমতা
এক ঝাপে হারিয়ে যেতে চাই

বুকে জমে থাকা ঘাম তুলে নেব শিকারী সাপের ন্যায়
আছড়ে পিছড়ে বেড়াবো তোমার উন্মুক্ত জমিনে
বিদগ্ধ কামনা হয়ে আশ্রয় খুঁজবো শিকারীর মত
দিন আর রাত এক হয়ে যাবে ভালবাসায়

শিশির বিন্দুর মতো ঘাম তোমার নাকের ডগায়
জানান দিচ্ছে রাগমোচনের প্রথম প্রহরের
আমার শরীরে তোমার পায়ের বন্ধন রাসায়নিক বন্ধনের মতো গড়ছে আর ভাঙছে
তীব্র পিস্টন সম হাঁপানির সাথে সাথে তোমার নিঃশ্বাস হয়েছে দ্রুত থেকে দ্রুততর

বুনো পুরুষ আজ ক্লান্ত ভীষণ
নোনা ঘামে চকচকে শরীর যেন বিজয়ীর আস্ফালন
রতিক্লান্ত মুখে সাফল্যের ছায়া
পেঁচিয়ে ধরে প্রকৃতির কটি,মুখ ডুবায় স্ফীত স্তনে

ডাঙায় তোলা মাছের মতো থর থর করে কাঁপা বুক তোমার
একটুকু মাথা রাখতেও ভয় লাগে ভীষণ,যদি আবার কাপন ধরে
যদি আবার প্রেমের নেশায় মত্ত হই যদি আবার তোমাকে ছিন্ন বিছিন্ন করার লোভ জাগে রক্তের কনায় কনায়?
কাঁপছে শরীর,কাঁপছে মন,উন্মত্ত অধরে অধর ডোবানোর আহবান
তীব্র তৃপ্তির বিজয় কেতন উড়িয়ে দুটো তনু এখন শান্ত আর একাকার।

Wednesday 8 August 2012

অসম্ভব রূপবতী সুইডিশ ভূত


নাম এরিক হওয়াতে কিছু সুবিধা আমি অবশ্যই ভোগ করি, অনেক গল্প উপন্যাসের নায়কের নাম, উচ্চারনে সহজ, একটা আংরেজ ভাব, সম মিলিয়ে খারাপ না। বয়স বেশী না পঁচিশ। যদি চেহারার বর্ণনা দেই তাহলে একটু সমস্যা আছে। মেয়ে পাঠকরা, সাবধান!, প্রেমে পড়ে যেতে পারেন। তাও বলছি। উচ্চতায় আমি প্রায় ৬ ফুট। বলিষ্ঠ শরীর। মাথা ভর্তি চুল। একদম স্ট্রেইট কাঁধ পর্যন্ত নেমে গেছে। ডাগর ডাগর চোখ। মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। এক কথায় সুদর্শন বলতে যা বোঝায় আমি তা। বাই প্রফেশন আমি ডক্টর। আমার পেশা ঠিক চেহারার সাথে যায় না। ডক্টরদের মধ্যে একটু আড়ষ্ট ভাব লক্ষণীয়। আমি তেমন না মোটেও। উদার, খোলামেলা, নারিসঙ্গ উপভোগ করি। জীবন নিয়ে নির্দিষ্ট কোন দর্শন ও নেই। দর্শন একটাই, মানুষের জীবন বাঁচাবো, দু হাতে কামাবো, আড়াই হাতে উড়াবো।

আমি ডাক্তারি পাস করেছি বেশী দিন হয় নি। প্র্যাকটিস শুরু করেছি একটা ক্লিনিকে। আপাতত আছি নিজের মতো করে। টুকটাক পড়াশুনা করছি। পোস্ট গ্রাজুয়েশন করার ইচ্ছে আছে। বিভিন্ন সেমিনার টেমিনার এটেন্ড করে বেড়াই এখন। আসলে এগুলো সব এক্সকিউজ। দেশ বিদেশে ঘোরাঘুরিই মূল লক্ষ্য। মোটামুটি এঞ্জয়েবল লাইফ বলা চলে। এবারের কিস্তিতে এসেছি উপসালা, সুইডেন। উপসালাতে চমৎকার একটা ইউনিভার্সিটি আছে। নাম উপসালা ইউনিভার্সিটি। বহু পুরাতন ইউনিভার্সিটি। এই ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ছিলেন ক্যারোলাস লিনিয়াস। জ্ঞানী মানুষ। শ্রেণীবিন্যাস বিদ্যার জনক। তো আমি এই ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিনের এক সেমিনারে এটেন্ড করবো। অনলাইনে সব ফর্মালিটিজ সেরে নির্দিষ্ট দিন ক্ষণে রওনা দিলাম সুইডেন। সুইডেন বলা ঠিক না। উপসালা বলা উচিত। স্টকহোম আমি আগেও এসেছে। এবারই প্রথম উপসালাতে। বলা হয় নি আমার বাড়ি কিন্তু নরওয়েতে। সুইডেনের প্রতিবেশী দেশ। আমাদের সব কিছু প্রায় কাছাকাছি ধরণের।

যেদিন উপসালায় পৌঁছলাম, ঘড়িতে দেখি সময় কম, বুঝলাম হোটেল খুঁজতে গেলে দেরী হয়ে যাবে। সরাসরি ট্যাক্সি নিয়ে সেমিনারে এটেন্ড করলাম। সেমিনার শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বের হলাম হল থেকে। এখন হোটেল খোঁজার পালা। ভার্সিটির কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়। ইচ্ছে করছে না। বেটার কোন ট্যাক্সি নিয়ে ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করা।

আমি একটা ট্যাক্সি নিলাম। ড্রাইভার আফ্রিকান। চেহারায় বোঝা যায়। আজকাল এশিয়া, আফ্রিকা থেকে প্রচুর মানুষ চলে আসছে ইউরোপে। জাতিগত ভিন্নতা থাকলেও মানিয়ে নিয়েছে বেশ। আমি হোটেল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই চমৎকার ইংরেজি তে বলল কাছেই একটা হোটেল আছে। ক্লেরিওন হোটেল। আমাকে নিয়ে গেলো হোটেলে। আসলে হোটেলটা এতো কাছে ট্যাক্সি নেয়ার দরকার ছিল না হেঁটেই যাওয়া যেতো। হোটেলের আউটলুক ভালো। আমি ফর্মালিটিজ সেরে চেক ইন করলাম।

তিন তারা, চার তারা বা পাঁচ তারা যেকোন হোটেলের যে বিষয়টা আমার ভালো লাগে সেটা হোল নীচ তলার মনোরম অফিস আর প্রকৃতির ছাপ। এই হোটেলও তার ব্যতিক্রম নয়। একটা ক্যারিবিয়ান নারিকেল গাছ দেখা যাচ্ছে ঠিক মাঝখানে, এর পাশেই ছোট একটা পুল, আমি নিশ্চিত কাছে গেলে দেখা যাবে সেখানে কিছু মাছ সাতার কাটছে এবং অবধারিত ভাবে মাছের রং হবে নীল,গোলাপি এবং লাল। এছাড়াও দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট সুন্দর করে ছাটা বুশ।

সেমিনার হোটেল করে আমার দু দিন কেটে গেলো উপসালায়। আসে পাশে তেমন কিছু দেখা হল না। কাছে একটা নদী আছে। নাম ফাইরিস। রুমের জানালা দিয়ে দেখা যায়। প্রশস্তে তেমন চওড়া না হলেও গোছানো টাইপ নদী। ইউরোপের প্রায় সব নদী গুলোই এমন দেখলেই মনে হয়। ক্যানভাস রঙ তুলি নিয়ে বসে যাই। শুনেছি কাছেই একটা চার্চ আছে। আমাদের এদিকের (স্কেন্ডিনেভিয়ান জোন) বিখ্যাত চার্চ। উপসালা ক্যাথেড্রাল। নরওয়ে ফিরবার আগে দেখে যাওয়ার প্ল্যান।

তৃতীয় দিনেও সেমিনার শেষ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে হোটেলে প্রবেশ করলাম। বাহিরের আবহাওয়া সুবিধের না। আকাশ জুড়ে মেঘ। যখন তখন জোরেশোরে বৃষ্টি নামবে। এরকম আবহাওয়া আমার আবার গান শুনতে ভালো লাগে।
হালকা পায়ে হেটে আমি ডেস্কে গেলাম। সুইডিশ রমনীরা অসম্ভব রূপবতী, যেমন এই ডেস্কের মেয়েটার কোকড়া চুল মেয়েটার রূপ সাধারনের থেকে একটু ভিন্ন করে ফেলেছে।
- গুড ইভনিং।
- গুড ইভনিং স্যার। আপনার দিন কেমন গিয়েছে?
- দিন তো সব সময় ক্লান্তই করে, সন্ধায় রুপবতী রমণী দর্শনে সেই ক্লান্তি দূর হয়।
- অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনি কি রাতে বাইরে খাবেন? নাকি আমাদের হোটেল লাউঞ্জ থেকে?
- রাত তো এখনও তরুনী, তরুনী রাতের মজা আধা পেটা থেকে, এখনো ঠিক করিনি কোথায় খাবো, আপনারা কটা নাগাদ খাবার সাপ্লাই করেন?
- স্যার ১০ টা। এই নিন আপনার রুমের চাবি।
- হাউ ক্যান আই গেট সাম সুইডিশ ক্লাসিক মিউজিক?
- পছন্দের শিল্পী এর নাম বললে আমরা রুমে তার মিউজিক সিডি পৌঁছে দেব।
- আই উইল কল ইউ দেন।
বা দিকে মোড় নিয়ে লিফট এর দিকে এগিয়ে গেলাম আমি,ঢুকে পড়লাম লিফটে। সাথে আরো আছেন দুজন ভদ্রলোক, আমি তাকিয়ে বিনয়ের হাসি দিলাম, হাসিতে সুইডিশ কালচার আর মানুষের প্রতি আমার ভক্তি আর ভালোবাসা মিশিয়ে দিলাম। দরজা বন্ধ হতেই আমি সোজা তিন চাপলাম। কয়েক সেকন্ড পরই তিন তলা।

নেমে ডান দিক থেকে ১৬ নাম্বার রুমটা আমার জন্য বরাদ্দ। হাটতে থাকলাম সেই দিকে,দুজন রুম সার্ভিস আমাকে অতিক্রম করার সময় মৃদু হাসি হেসে গেল,এর পর আর একজন আসলো সামনের দিক থেকে,এই রমণী আমার দিকে ভয়ঙ্কর শীতল চোখে তাকাল, আমিই চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম,বহুদিন এমন শীতল চোখ দেখিনি, মাছের মতো অপলক চাহনী। মাছ আর সাপ তাদের চোখ বন্ধ করতে পারে না, কারন তাদের চোখের পাতাই নেই,কিন্তু এই মেয়ের তো চোখের পাতা আছে, তার অপলক দৃষ্টি হবার কারন বুঝতে পারলাম না। আমি একবার পিছন ফিরে তাকালাম, সেই রমনীর র ও দেখা যাচ্ছে না, হুশ করে কোথায় গেল? আজিব তো! মাত্রই আমাকে পার করল রমণী, কোথায় গেল হুট করে? দুনিয়ার মানুষজন কি অনেক দ্রুতগামী হয়ে গেল নাকি আমিই কচ্ছপের মতো ধীরগতির হয়ে গেলাম? ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে চাবি ঘুরিয়ে রুমে ঢুকলাম, বিছানার ধবধবে শাদা চাদর দেখে মনটা সিন্ধ হয়ে গেল, নরওয়ের বরফ ঢাকা ধু ধু প্রান্তর এর একটা আবেশ।
সোজা ফ্রিজ খুললাম, পৃথিবীর ৭০ ভাগ মানুষ ফ্রিজ খোলে কিছু পান করার জন্য আমিও তার বিপরীত নই, আপেল জুস নিলাম গ্লাসে আর একটা আভাগ্রাডো ফল, প্রচুর পটাশিয়াম সরবারহ করে এই ফল, কলা থেকে তিন গুন।

জানালার পর্দা খুলে বাইরে তাকালাম, সারি সারি গাড়ির লাইন রাস্তায়, ঘরে ফেরা মানুষের ব্যস্ততা। কেউ ফিরছে সন্তানের কাছে, কেউ মায়ের কাছে কেউবা প্রিয়তমার কাছে, সময় বড় দ্রুত গড়ায়। গড়ানো সময় নিয়ে রাশিয়ান শিল্পী দিদীউলিয়ার চমৎকার কিছু গান আছে, দেখা যাক একটা সিডি যোগাড় করা যায় কিনা ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম বিছানায়, এক পায়ের আঙ্গুলের সাহায্য নিয়ে অন্য পায়ের জুতো খুলে ফেললাম, গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়, একটা গোসল নেয়া দরকার, শরীর টানছে কিন্তু মন টানছে না। মনের সাথে যুদ্ধ করে আর গোসলে যাওয়া হল না। শরীর এলিয়ে দিলাম বিছানায়।

ঘুম ভাঙ্গল কাফের খোচায়, মাথার নীচে হাত নিয়ে এসেছিলাম, কাফের খোচা লেগেছে চোখের পাশে। নাহ আর না, আর ঘুমালে রাতের খাবার মিস হয়ে যাবে, বাইরেও যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, এখনও মুজোও খোলা হয়নি। ইন্টারকমে নক করলাম
- রাতের খাবারের কি মেন্যু?
- মেইন কোর্স স্যার?
- হুম।
- মাটন কাটলেট, বিফ স্টেক, মেরিনেটেড ফিশ,টার্কি গ্রিল............
- হয়েছে হয়েছে, একটা ডাবল বিফ স্টেক, সল্ট, পিপার, স্পাইস সহ।
- স্যার আর কিছু?
- একটা সিঙ্গেল গ্রিক সালাদ, মাশরুমের ডাবল সুপ, খয়েরি পাউরুটী, আর সিঙ্গেল কেক, চিজ অথবা ফ্রুট আইদার উইল ডু।
- ১০ মিনিট পর পৌঁছে যাবে স্যার।

একটু শীত শীত লাগছে, কন্ডিশনারের তাপমাত্রা বাড়াতে বাড়াতে ভাবলাম আজ রাতে যদি গল্প করার কেউ থাকলে খুব জমত, সুইডেনে আজ শেষ দিন আমার। কাল চলে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে।
দরজায় নকের শব্দ শুনেই চেচালাম, কাম ইননননন।

অবিশ্বাস অপেক্ষা করছিল আমার জন্য, সেই মেয়ে খাবার নিয়ে ঢুকল রুমে। সর্পচোখী রমণী। সোজা টেবিলে গিয়ে খাবার রাখলো। আমার সামনে এসে দাঁড়ালো ঠাণ্ডা গলায় বলল
-আপনার মুজা থেকে গন্ধ আসছে,আমার মুজার গন্ধ,রসুনের গন্ধ,মরিচের গন্ধ সহ্য হয়না। আপনার খাবার এনেছি মরিচ ছাড়া।
- ইয়ে মানে আমার গন্ধ আমার সহ্য হলেই তো হয়,আপনার সহ্য না হলে তো কিছু আসে যায় না,তাই না?
আপনার এইডস হয়েছে এই ঘোষণা দিয়ে রোগীর দিকে যেভাবে তাকানো দরকার সেইভাবে তাকালাম।
- আসে যায় কারন,আমি সারারাত এখানে থাকবো। আপনি গল্প করার জন্য কাউকে খুঁজছিলেন।
সারাজীবন মড়দেহ নিয়ে ঘাটাঘাটি করা আমার কলজে শুকিয়ে এল,এই মেয়ে কিভাবে জানলো আমি সারারাত গল্প করার মানুষ খুঁজেছি?
- ভয় নেই,আমি মানবী না আমি ভূত।
- হা হা হা,দারুন,অসম্ভব রূপবতী সুইডিশ ভূত? নাকি পিঙ্গলকেশী রুম সার্ভিস ভূত? না না,মুজোর গন্ধশোঁকা ভূত?
আমি হো হো করে হাসতে থাকলাম,ভাবটা এমন যেন দিন সেরা কৌতুক করে ফেলেছি,রমনীর মুখে কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। আমি একটু চিন্তিত হলাম।
- আপনাকে ধন্যবাদ,খাবার দিয়ে যাবার জন্য,এখন আসতে পারেন।
- আর যদি না যাই?
- ইন্টারকমে ফোন করব।
- করুন না।
ফোন তুলে কোন ডায়াল টোন শুনতে পেলাম না। এবারে আমার অবস্থা খারাপ। আমি সোজা সাপটা জিজ্ঞাসা করলাম,কি চান আপনি? সমস্যা কি আপনার? কি নাম আপনার?
- নাম ফিলিপা,কিছুই চাই না,কোন সমস্যাও নেই।
- আপনি আসলেই ভূত?
- জি আমি আসলেই ভূত,এই হোটেলেই আমার মৃত্যু হয়েছে। আগুনে পুড়ে,গত ৬ বছর আগে।
- ভূত আপনি খুবই ভালো কথা,এখন কি করতে চান?
- গল্প শুনতে চাই,গল্প শুনাতে চাই। আপনি খাওয়া শুরু করুন,খেতে খেতে গল্প করবো।
ভালোভাবেই কথা বলছে,ভূত হলেও নিরীহ ভূত,সমস্যা আপাতত নেই,না খেপে গেলেই হয় এখন।
- আপনিও আসুন,আমার সাথে বসে খান। আ ডিনার উইথ আ বিউটিফুল ঘোস্ট। হা হা হা
হাসিতে গড়াগড়ি দেবার ইমো দিলাম,ফিলিপা আমার দিকে শীতল ভাবে তাকিয়ে আছে,অপলক চোখে। আমি চুপ মেরে গেলাম।
- ভূতেরা খায় না,অথবা পান করে না এটা আপনি জানেন না?
- আমি ভূত সম্পর্কে খুবই কম জানি,আপনিই আমার জীবনে দেখা প্রথম ভূত,তাও আবার রূপবতী ভূত।
- আমি কেন এসেছি জানেন?
- কেন?
- আমার জীবনে দেখা শেষ মানুষটা আপনার মতো।
- মানে?
- যখন আগুন লাগে আমি তখন একটা রুম গোছাচ্ছিলাম,টের যখন পাই অনেক দেরি হয়ে গেছে, তখন আমি দৌড়ে লিফট এর দিকে যাই,লিফটে একজন পুরুষ ছিল, উনি অপেক্ষা না করে দরজা বন্ধ করে দেন,আমি ফিরে এসে সিঁড়ি ভেঙে নামার চেষ্টা করি,ততখনে আমার গায়ে আগুন লেগে গেছে,পা পিছলে সিঁড়ি থেকে পরে যাই,সেখানেও আগুন,আমি দিক খুজে পাইনি,কালো ধোয়াতে সব অন্ধকার। এরপর আর কিছুই মনে নেই। এখন এখানেই থাকি,মাঝে মাঝে যাদের পছন্দ হয়,এসে গল্প শুনিয়ে যাই।
- ভয়ঙ্কর। আসলেই ভয়ঙ্কর। ফায়ার সার্ভিস কি করেছে?
- আমার মৃত দেহ উদ্ধার করেছে।
- আমি এখন চলে যাবো। আপনি ঘুমিয়ে যান। আপনার সাথে গল্প করা শেষ।
- আচ্ছা দাঁড়ান,আপনাকে একটা জিনিস দেই।
আমি সুটকেস খুললাম,সেখান থেকে বের করলাম একটা এলব্যাম,ছবি রাখার এ্যালবাম,এয়ারপোর্ট থেকে কিনেছিলাম।
- এটা নিন,আমাদের পরিচয়ের স্মারক হয়ে থাকুক।
- আচ্ছা আমি যাই,আপনি ঘুমান।
আমি ইচ্ছা করেও চোখ মেলে রাখতে পারলাম না,ঘুমে ঢলে পড়লাম। ঘুম ভাঙল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে।
দরজা খুলে দেখলাম রুম সার্ভিস,আবার খাবার হাতে দাঁড়ানো,হতভম্ব আমি খাবার হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলাম,ফিলিপা যেখানে খাবার রেখেছিল সেখানে কিছুই নেই।

 আমি ল্যাপটপ অন করে ৬ বছর আগের সাল আর হোটেলের নাম লিখে সার্চ দিলাম,উত্তর এল আগুনে ৬ জনের মৃত্যু আর ১৩ জন দগ্ধ। আর আমার সুটকেসের এ্যালবামও নেই।

আপেল বিলাস


মাথার উপর খড়খড়ে রোদ,সূর্য ঠিক মাথার উপরে। রুমালে কপাল মুছে আসলাম তার সিটের নীচ থেকে পানির বোতল বের করে। ঢক ঢক করে পানি ঢালে গলায়। মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হয়। সিএনজি অটোরিক্সাটা দাড়া করায় মহাখালী ফ্লাইওভার এর নীচে। ইঞ্জিন বন্ধ করে বাইরে বের হয় আসলাম। ভালো করে একটু শ্বাস নেবার চেষ্টা করে,শীশায় ভারি ঢাকার বাতা সেই সুযোগ দিতে চায় না।

চোখ পিট পিট করে তাকায় নিজের সিএনজি এর দিকে,গত ৪ বছর আগের কেনা,ফাতেমার সব সঞ্চয় আর নিজের সব সঞ্চয় ভেঙে কেনা। কেনার পর ঘর ভাড়া বাকি পড়েছিল প্রায় ৫ মাসের,ফাতেমা হাতে পায়ে ধরে ৫ মাস থেকেছে সেই বাড়িতে। ফাতেমার মতো একজন স্ত্রী থাকা আসলে ভাগ্যের ব্যপার,মনে মনে ভাবে আসলাম।

এক রুমের একটা ছাপরা ঘর,একটা সিএনজি, আর গার্মেন্টস কোম্পানিতে ফাতেমার চাকরি এই নিয়েই আসলামের সংসার। সেই কলেজ পড়ার সময় গ্রাম ছেড়েছিল আসলাম,সাথে ছিল ফাতেমা। লঞ্চ থেকে নেমেই সদর ঘাট,শহরে পৌছাতে পৌছাতে হারিয়েছিল ব্যাগ আর টাকা। ফাতিমার বয়সের একটা মেয়ে উড়ে বেড়ায়, বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেয়,জন্মদিন পালন করে,ভার্সিটি যায় এগুলো আসলাম জানে,অনেক সময় দল বেধে মেয়েরা ওঠে আসলামের সিএনজিতে। আসলামের তখন মনে পড়ে নিজের স্ত্রী এর কথা। তবে হ্যাঁ,ফাতিমাকে অনেক রঙের মাঝে না রাখতে পারলেও কখনও পথভ্রস্ট্র হয়নি আসলাম, বস্তির আশে পাশে বাসার অন্য পুরুষের মতো ফাতিমার গায়ে হাত তোলেনি কোনদিন,বেশ্যাপাড়ার দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি। ভালবেসেছে আসলাম সবটুকু দিয়ে।

-সিএনজি যাবা?
- কই?
- টঙ্গি বাজার?
- জি না।
-আরে চল, মিটারের থেকে বেশি দিমু
-না,ভাই। আমার অন্য দিকে যেতে হবে।

প্লানটা ততক্ষনে মাথার মধ্যে গেঁড়ে বসেছে আসলামের। দশ পা হাঁটলেই ফলের দোকান। সেখানে পৌছাল আসলাম।

- ভাই আপেলের কেজি কত?
- কত কেজি লাগবে আপনার?
- খুচরা দুইটা লাগতো।
- খুচরা তো বেচি না,ভাই।
- আরে ভাই দেন না। ফাও তো নিতেছি না।
- আচ্ছা ২০ টাকা দেন।
দুটো আপেল একটা কাগজের ব্যাগে পুরে সিএনজি এর কাছে ফিরে আসে আসলাম। ইঞ্জিন চালু করতেই এক মেয়ে এসে দাঁড়াল
- ভাই যাবেন?
- কোথায়?
- মধ্য বাড্ডা।
-জী যাবো
- কত?
- আপনার যা ইচ্ছা হয় দিয়েন,আপনি তো যান সবসময়।

পাক্কা ড্রাইভারের মতো বড় বড় বাস ট্রাকের ফাঁকা দিয়ে সিএনজি চালিয়ে মহাখালির জ্যাম পার করে আসে আসলাম। ঘণ্টা খানেক পর মেরুল বাড্ডার রাস্তায় চলে আসে আসলাম। সেখানে সিনেমা হলের বড় একটা হোরডিং, জসিম- শাবানার কালিয়া ছবির। জসিমের গোফটা বড্ড ভালো লাগে আসলামের।
মধ্য বাড্ডার রাস্তায় চলে আসে আসলাম। মসজিদের সামনে দাড়াতে বলে মেয়েটা। ব্যাগ থেকে বের করে দেয় একটা ১০০ টাকার নোট আর খুচরা ১০ টাকা।

গাড়ি ঘুরিয়ে মেরুল বাড্ডার রাস্তায় চলে আসে আসলাম,এখন আর কোন খেপ মারবে না সে। গাড়ি পার্ক করে গলির মধ্যে,ওইতো দেখা যায় ফাতেমার গার্মেন্টস। দুপুরের খাবারের সময় দিয়েছে,সব মেয়েরা বের হয়ে আসছে,কারো হাতে বাটি,কারো হাতে ছোট টিফিন ক্যারিয়ার। ফাতেমাও বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসে বাটিতে করে। সিঁড়ি ভেঙে দোতালায় আসে আসলাম,ডান দিকের রুমেই মেয়েরা বসে,ঢুকতেই ফাতেমাকে দেখতে পায় সে। ফাতেমার চোখে অবিশ্বাস দেখতে পায় আসলাম

- আপনি এইখানে কি করেন?
- তোমারে দেখতে আসলাম।
- খেপ নাই আপনার?
- এই দিকেই আসছিলাম,চিন্তা করলাম তোমারে দেইখা যাই,খুব দেখতে ইচ্ছা করছিল।
কাগজে মোড়ানো আপেল দেয় আসলাম ফাতেমার হাতে।
- খাবার পড়ে খাইয়। আমি তাইলে এখন যাই।
- কই যান আপনি,শেষ মাথায় বাথরুম,হাত ধুয়ে আসেন,ভাত খাবেন।
- ভাত তো একজনের,দুই জন মানুষ কেমনে খামু?
- আপনি যান তো,হাত ধুয়ে আসেন।
হাত ধুয়ে ফিরে এসে আসলাম দেখে,দুই বাটিতে ভাত বেটে বসে আছে ফাতেমা। বিছানো খবরের কাগজ এর উপর বসে আসলাম।
- আগে মাছ দিয়া খান,শেষ হইলে ডাইল নিবেন।
- আচ্ছা।

হাতে ভাত মাখতে থাকে আসলাম,মাছ আর আলুর ঝোল,সাথে একটা কাচা মরিচ,সামনে একটা ছোট কাগজে লবন। আস্তে আস্তে খাওয়া শুরু করে আসলাম। ফাতেমা এটা সেটা জিজ্ঞাসা করে,আসলাম উত্তর দেয়।
- ভাত কই পাইলা ফাতেমা?
- একজনের কাছ থেকে চাইয়া নিছি,অল্প একটু।
প্লেট উঠিয়ে চুমুক দিয়ে ডাল খেয়ে,উঠে পরে আসলাম। হাত ধুয়ে আসে। ফাতেমা তখনও বসে আছে,বড্ড আস্তে আস্তে খায় ফাতেমা।
- আমি গেলাম,নীচে গাড়ি রাইখা আইছি।
- একটা আপেল নেন,দুইটা দিয়া আমি কি করমু?
- তোমার কাম কখন শেষ হইব আজকে?
- ৫ টার সময়।
- আইচ্ছা তাইলে,নীচে দাঁড়াইয়ো তুমি,আমি আসমুনে তোমারে নিতে।
- কেন? আমি তো একলাই বাসায় যাই,আপনার আসার কি দরকার?
- কালিয়া ছবি দেখমু আইজকার আমরা, জসিম –শাবানার। থাইকো নীচে।

সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে থাকে আসলাম,পিছনে ফিরে তাকায় না একবারও। তাকালে হয়ত আসলাম দেখত,ফাতিমার চোখে চোখে জল,দু ফোটা ভালোবাসার জল।

Tuesday 7 August 2012

৭১ এর জেনোসাইড (নিক্সন-কিসিঞ্জার)


বটমলেস বাকেট অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বিখ্যাত উক্তি কম বেশি আমরা সবাই শুনেছি।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের কথা(তালিকা দেবার প্রয়োজন বোধ করছি না) আমরা সব সময় হৃদয়ে রাখবো। কিন্তু একজন বিদেশী যুদ্ধাপরাধীর কথা না বলে আর পারছি না, মানবতা পায়ে ঠেলার মতো উপমা শুনেছি,হেনরি কিসিঞ্জারের কথা জেনে উদাহরণ জানার বিলাসিতাও হয়েছে।

ব্যবচ্ছেদ করলে একটা সহজ সমীকরণে আসা যায় খুব সহজে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিগুলো ছিল,ভারত,তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ব্রিটেন। আর ঘোরতর বিরোধী ছিল যুক্তরাষ্ট্র,চীন এবং সৌদি আরব। ইতিহাস এবং দলিল এদের প্রমাণ দেবে।

আমেরিকার কেন্দ্রীয় প্রশাসন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্নেই পাকিস্তানের সপক্ষে তার নীতি ঘোষণা করে। তারা গণতন্ত্রকামী বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে এগিয়ে আসেনি। তারা দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে স্বৈরাচারী সামরিক জান্তা অগণতান্ত্রিক শক্তির সপক্ষে। তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড এম. নিক্সন এবং হেনরি কিসিঞ্জার ছিলেন নিক্সনের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তি, যিনি তখন আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক প্রেসিডেন্টের একান্ত সহকারী।

এই নিক্সন-কিসিঞ্জার নিয়ন্ত্রিত মার্কিন নীতিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকা পাকিস্তানের এমন একটি অত্যাচারী সরকারের সপক্ষে দাঁড়াল যে সরকার তার পূর্বাঞ্চলের নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন-কিসিঞ্জারের প্রকাশ্য সমর্থন কিংবা পাকিস্তানের প্রতি ঝুঁকে পড়া নীতি অনুসরণ নিছক পক্ষপাতিত্বমূলক ভূমিকা ছিল না। তখনকার মার্কিন প্রশাসনের নীতি এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়, যা ঐ ঝুঁকে পড়ার সীমা ছাড়িয়ে যায়। বলা যায়, প্রায় অনেকটা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে তথা পাকিস্তানের সপক্ষে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ কিংবা মদদদান। আমেরিকা ঐ অবস্থান গ্রহণ করার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে পাকিস্তানকে সামরিক ও নৈতিক সমর্থন জানায়।

পাকিস্তানের পক্ষে নিক্সন প্রশাসনের ঝুঁকে পড়ার নীতির এক বলিষ্ঠ প্রয়োগকারী ব্যক্তি হচ্ছেন- হেনরি কিসিঞ্জার, যিনি তখন বাংলাদেশের ব্যাপারে প্রেসিডেন্টের যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত আগ্রহী ও পারদর্শী। কিসিঞ্জার তাঁর নিজের উচ্চতর ক্ষমতা ও যোগ্যতার অধিকারী হয়ে এবং প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সমীকরণের বলে তিনি এমনই একজন শক্তিশালী ব্যক্তিতে পরিণত হন যার ফলে তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন নীতি প্রণয়নের কেন্দ্রীয় চরিত্রে আবির্ভূত হন।

নিক্সন-কিসিঞ্জার ছিলেন একাত্তর সালের বাংলাদেশ বিষয়ে আমেরিকার নীতি নির্ধারণে কর্তৃত্বপ্রাপ্ত দুজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাঁরা গোপনে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তারাই ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার সপ্তম নৌ-বহর বঙ্গোপসাগরে মোতায়েনের নির্দেশ দেন, যার মূল লক্ষ্য ছিল ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়নকে সর্বোচ্চ ভীতিপ্রদান এবং পূর্ববাংলা থেকে সরে আসতে পাকিস্তান যেন কিছু সময় পায়।

এ ছাড়াও ব্লাড টেলিগ্রাম এর কথা বলতে হয়। আর্চার কেন্ট ব্লাড একজন মার্কিন নাগরিক যিনি ১৯৭১-এ বাংলাদেমে মার্কিন কনসাল জেনারেল হিসাবে কর্মরত ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন দিয়েছলেন। নিক্সন-কিসিঞ্জারের পাকিস্তানপন্থী অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকার জন্য তাকেঁ “বাংলাদেশের যুদ্ধবিবেক” হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। সর্বপ্রথম তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে, পূর্ব পাকিস্তানস্থ মার্কিন দূতাবাসে পলিটিক্যাল কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়ে। আর্চার ব্লাড তাঁর দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ বইয়ের সূচনায় লেখেন, ‘একাত্তর নিয়ে লিখতে বসে আমার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কারণ আমার বহু বন্ধুর মুখ ভেসে উঠছে, যারা শহীদ হয়েছে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে গণহত্যা শুরু করে। ৬ এপ্রিল ১৯৭১ ঐতিহাসিক মার্কিন দূতাবাস থেকে একটি তারবার্তা পাঠানো হয়েছিল ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরে। ঢাকায় কর্মরত মার্কিন কর্মকর্তারা ২৫ শে মার্চের ‘কলঙ্কিত রাতের’ গণহত্যা এবং সে বিষয়ে নিক্সন-কিসিঞ্জারের অন্ধ ইয়াহিয়া-ঘেঁষা নীতির প্রতিবাদ জানাতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছিলেন।

তাঁরা খুব ভেবেচিন্তে একটি তারবার্তা লিখেছিলেন যাতে স্বাক্ষর করেছিলেন ব্লাড ও তাঁর ২০ জন সমর্থক সহকর্মী। তাঁরা তাতে ঢাকায় ইয়াহিয়ার গণহত্যার প্রতি ওয়াশিংটনের অব্যাহত নীরবতার নিন্দা করেছিলেন। ব্লাড তাতে কেবল স্বাক্ষরই দেন নি, বাড়তি এক ব্যক্তিগত নোটও লিখেছিলেন। এতে তিনি রিখেছিলেন, “আমি বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তানে এখন যে সংগ্রাম চলছে, তার সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিণতি হলো বাঙালিদের বিজয় এবং এর পরিণতিতে একটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা।“ এই ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ বস্তুত তখনকার নিক্সন-কিসিঞ্জারের দুর্গে বোমা ফেলেছিল। ‘’দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’’ নামীয় গ্রন্থের লেখক ক্রিস্টোফার হিচেন্স মতে ‘মার্কিন ইতিহাসে ব্লাড টেলিগ্রামের কোনো তুলনা নেই।’ কিসিঞ্জার এ জন্য ব্লাডকে নির্বাসন দণ্ড দিয়েছিলেন।

ক্রিস্টফার হিচেন্স তার দি ট্রায়াল অফ হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ের একটি পর্বে বাংলাদেশ,৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিবর্তী কিসিঞ্জারের ভূমিকা সম্পর্কে লেখেন।
আর একটি কথা না বললেই নয়,কিসিঞ্জার শুধু বাংলাদেশ জেনোসাইড নয়, পৃথিবীর আরও বেশ কয়েকটি দেশের মানবতাবিরোধী কর্মকান্ডে তার যোগ থাকার বিষয় নিশ্চিত করা হয়।

হিচেন্স এর বইটির যে পর্বে বাংলাদেশ কথা ও কিসিঞ্জারের কথা উল্লেখ রয়েছে সে পর্বটি অনুবাদ করছি।
অনুচ্ছেদ- বাংলাদেশ

পৃষ্ঠা-৪৪

১৯৭১ সাল গণহত্যা শব্দটি বিশ্বের দরবারে খুব পরিচিত করে তোলে!! ততকালীন সময়ে পাকিস্তানের ‘বাঙ্গালী’ জনগোষ্ঠির, তথা বাংলাদেশীদের পক্ষে ইউনাইটেড স্টেট কনসিউলেট তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি বার্তা পাঠায়। বার্তাটি পাঠানো হয় ৬ এপ্রিল ১৯৭১, যেখানে প্রধান স্বাক্ষরকারী ছিলেন তৎকালীন ঢাকার কনাস্যিউল জেনারেল আর্চার ব্লাড। অন্য অর্থে এটাকে হয়ত ব্লাড টেলিগ্রামও বলা যেতে পারে! মার্গেন্থাসের বিবরনী থেকে ভিন্ন এই বার্তাটি সরাসরি ওয়াশিংটনে পাঠানো হয়, যেখানে গনহত্যার বিষদ বর্ণনার চেয়ে গণহত্যা সম্পর্কে আমেরিকার সরকারের ভূমিকা নিয়ে বেশি সমালোচনা করা হয়। এর মূল বক্তব্য ছিলঃ
‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র বিরোধী কাজের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সরকার সাধারণ জনগনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে পশ্চিম পাকিস্থানী শাসক গোষ্ঠিকে নিয়ন্ত্রন করতে , এমনকি বিশ্বের দরবারে তাদের আসল রূপ প্রকাশেও তারা সক্ষম হয়নি যা কিনা অন্যান্য দেশের সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের সাক্ষী আমাদের সরকার, আর হাস্যকরভাবে ঠিক একই সময় তারা গনতনত্রের ব্যাখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি বার্তা পাঠায়, যেখানে পূর্ব পাকিস্থানের প্রবল জনপ্রিয় এবং সংখ্যা গরিষ্ঠ ভাবে বিজয়ী নেতাকে আটকের প্রতিবাদ করা হয়। সেই সাথে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধের আহবানও জানান হয়……… কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা নিরব দর্শকের ভূমিকা নেই- এমনকি মানবিক দিক থেকেও। এটি একটি দেশের অভ্যন্তরীন বিষয় বলে আমরা স্রেফ মুখ বুজে রইলাম যা একসময় গনহত্যায় রূপ নিল! সাধারন আমেরিকানরা এখন এর প্রতিবাদ করছে, সিভিল সার্ভেন্ট হিসেবে আমরাও সরকারের এই নিরবতাকে সমর্থন করি না, বরং আশা করছি সরকার এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা রেখে আমাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতির একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।‘
এই বার্তাটিতে তৎকালীন বাংলাদেশে বসবাসরত বিশ জন আমেরিকান কূটনৈতিকের সাক্ষর করেন, পরবর্তীতে স্টেট ডিপার্টমেন্টে আসার পর আরো নয় জন কর্মকর্তা এতে একাত্নতা প্রকাশ করে সাক্ষর করেন। স্টেট ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে আমাদের স্বাধিনতার স্বপক্ষে এটাই সবচেয়ে জননন্দিত এবং শক্তিশালী বক্তব্য ছিল।
২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তৎকালীন রাজধানী ঢাকা আক্রমন করে,এবং শেখ মুজিবর রহমান কে অপহরন করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মুজিব অনুসারি এবং সাধারন জনতাকে লক্ষ্যহীন করা। সমস্ত বিদেশী মিডিয়াকে ঢাকা থেকে জোর পূর্বক বের করে দেয়া হয়,ততকালীন ম্যাসাকারের সরাসরি প্রমান পাওয়া যাবে,মার্কিন রেডিও থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রচারকৃত বার্তা সমুহে। আর্চার ব্লাড নিজে সরাসরি একটি বার্তা তখন কিসিঞ্জারের অধিকৃত জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে পাঠান।
সেনাবাহিনীর সৈনিকেরা তখন সাধারন মানুষের বাড়িতে আগুন দেয়া শুরু করে,এবং মানুষগুলোকে গুলি করে হত্যা করে।( এই বন্দুকগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক এসিসটান্ট প্রোগ্রামের অন্তর্ভুক্ত ছিল)
এই সময় লন্ডন টাইমস এবং সানডে টাইমস যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করে,এন্থনি মাসকারহেনাস এর সেই প্রতিবেদন গুলো তারা সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য প্রচার করে কালো রাতের মুখোশ উম্মোচন করে। খুন,ধর্ষণ,এবং সাধারন মানুষের উপর অত্যাচারের সেই রিপোর্টগুলো মানুষকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। শিশু ও নারী হত্যা করে সেনাবাহিনী তখন সাধারন মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
প্রথম ৩ দিনে ১০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করা যায়,পরের কয়েকদিনের হিসাবে যা মিলিওন এর হিসাবে গিয়ে ঠেকে।
সকল হিন্দু ধর্মালম্বী জনগন তখন বাস করছিলেন একটি নারকীয় পৃথিবীতে।
প্রায় ১০ মিলিওন উদ্বাস্তু মানুষ তখন ভারত সীমানা পথে যাত্রা শুরু করে।
পুরো জেনসাইড কে তিনটি পয়েন্টে বর্ণনা করা যায়
১) সাধারন নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে জটিলতার অবতারনা।
২) পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে একটি আগ্রাসি সিধান্তের উদাহরন।
৩) সল্প সময়ের মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক ক্রাইসীস সৃষ্টি।
নিউ দিল্লিতে অবস্থান রত তৎকালীন মার্কিন কূটনিতিক কেনেথ কেটিং বাংলাদেশের সাধারন মানুষের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি ছিলেন সাবেক নিউ ইয়র্ক সিনেটর, তিনি ২৯ মার্চ মার্কিন প্রশাসনকে বলেন “ “promptly, publicly, and prominently deplore this brutality” এছাড়াও তিনি এই বর্বর অপারেশন অবিলম্বে বন্ধ করতে প্রশাসনকে সতর্ক করে দেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন “ “prior to inevitable and imminent emergence of horrible truths.”

নিক্সন ও কিসিঞ্জার এই বার্তার পরিপ্রেক্ষিতে অতি দ্রুত পদক্ষেপ নেন,আর্চার ব্লাডকে তার পদ ঠেকে অব্যাহতি দেয়া হয়,আর কেটিং কে বলা হয় যাতে তিনি তার ভারত ঘেঁষা আচরন শুধরে নেন। তাকে সরাসরি বলা হয় “taken over by the Indians.”

এপ্রিল মাসের শেষ দিকে,ঠিক যখন গনহত্যার হার সব ঠেকে উচু,হেনরি কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খানকে একটি বার্তা পাঠান,যেখানে কিসিঞ্জার ইয়াহিয়াকে তার সময়োপযোগী সাহসী সিধান্ত ও কূটনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

নিক্সন- কিসিঞ্জারের এই পাকিস্তান প্রশাসন ঘেঁষা মনোভাব,ও সেনাবাহিনীর যুদ্ধ অপরাধ সমর্থনের কারণ খুজতে গেলে আরও একটি বিষয় উঠে আসে।
কেন নিক্সন- কিসিঞ্জার জেনারেল ইয়াহিয়াকে সমর্থন জানিয়েছিল?
এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেবিল টেনিস দলকে চীনের বেইজিং এ একটি ট্যুরনামেন্ট খেলতে আমন্ত্রন জানানো হয়,মাধ্যম হিসেবে ব্যাবহার করা হয় পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রদূতকে। এবং সেই রাষ্ট্রদূত টেবিল টেনিস খেলার আমন্ত্রন পত্রের সাথে চীন প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য একটি নৌ বহর পাঠানোর সুপারিশ নিয়ে আসেন। নিক্সন- কিসিঞ্জার আন্তর্জাতিক রাজনীতির দখল নিতে মিত্র পক্ষের সমর্থন পাবার নিমিত্তে,লাখ লাখ মৃত্যুগামী জনগণকে জেনে শুনে আগুনে ফেলেছেন,নীরবে সমর্থন দিয়ে গেছেন সেই সেনাবাহিনীর অপারেশনকে। কি নির্মম,বর্বর ক্ষমতালোভী দুজন রাজনীতিবিদ।

পৃষ্ঠা – ৫০

যুদ্ধকালীন বাংলাদেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে তার বিতর্কিত ভুমিকা নিয়ে কিসিঞ্জারকে সাংবাদিকদের বেশকিছু বিব্রতকর এবং বিদ্রুপাত্মক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল,যা তার আনন্দঘন চীন ভ্রমনের অনেকটাই ম্লান করে দেয়।তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং নেতাদের প্রতি তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন,এবং শেখ মুজিবকে তিনি(তার তৎকালীন সহকারী রজার মরিস এর ভাষ্যমতে) Salvador Allende এর সাথে তুলনা করেন।

১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার সেক্রেটারি অব স্টেট হওয়া মাত্রই,গনহত্যার প্রতিবাদে যোগদানকারী প্রত্যেকেই তার তীব্র রোষের সম্মুখীন হয়।

১৯৭৪ এর নভেম্বরে কিসিঞ্জার একটি সংক্ষিপ্ত এবং দায়সারা উপমহাদেশ সফরকালে বাংলাদেশে আটঘন্টার একটি যাত্রাবিরতি নেন,এবং তিন মিনিটের একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন। সেখানে ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে তিনি কেন নৌ-বহর পাঠিয়েছিলেন জানতে চাওয়া হলে,তিনি উত্তর দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন।তার ফিরে যাবার তিন সপ্তাহের মধ্যে, এখন আমরা জানি,ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের একাংশ বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের একটি দলের সাথে গোপন সাক্ষাৎ শুরু করে,যারা মুজিবের বিরুদ্ধে একটি অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছিল। ১৯৭৫ সালের ১৪ই আগস্ট,মুজিব এবং তার পরিবারের ৪০ জন সদস্য একটি সামরিক হামলায় নিহত হন।এর কয়েকমাস পরে,তার কিছু নিকটতম রাজনৈতিক সহকর্মীদেরও কারাবন্দী অবস্থায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

জন্ম পদ্যের গদ্যরূপ


এই রকম একটা লেখা লেখার কোন ইচ্ছাই ছিল না,জানিনা মুক্তমনা এই লেখা ছাপাবে কিনা। তবুও লিখছি। স্মৃতিচারণে পুরনো লেখা পড়তে জুড়ি নেই।
আজ ২৫শে মে। আমার জন্মদিন। সেই সাথে সাথে নজরুল জয়ন্তী। তবে আজ কবি নজরুলের ঢোল না পিটিয়ে নিজের ঢোল পিটানোর জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

তুষখালি ও আমি

আমার জন্ম এইসব কংক্রিট পাথর ইটের শহরগুলো থেকে অনেক দূরে। বর্তমান পিরোজপুর জেলার,মঠবাড়িয়া উপজেলার তুষখালি নামক ইউনিয়নে। তুষখালি আমার মামাবাড়ি।
তুষখালি কেন নাম হোল জায়গাটার,এই প্রশ্ন করেছি বহুজনকে,কিন্তু সন্তোষজনক উত্তর পাইনি কারো কাছে থেকেই,এক এক জন এক এক রকম কাহিনী ফাঁদে। তবে তুষখালির কিছু বিজয়গাথা রয়েছে।

জমিদারেরা তখন শাসন করত পুরো বাংলা,কিন্তু ধীরে ধীরে এক সময় বিভিন্ন কারনে কৃষকদের সাথে জমিদারদের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে, এই বিরোধের পরিণামস্বরূপ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিক্ষোভ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিক্ষোভ থেকে ঐ শতকের আশির দশকে জমিদার বিরোধী কয়েকটি বড় কৃষক বিদ্রোহ ঘটে। এগুলোর মধ্যে একটি বড় বিপ্লব হোল তুষখালি কৃষক আন্দোলন (১৮৭২-৭৫)।

এই ইউনিয়নের মানুষজন এখনও কৃষিকাজ ভিত্তিক জীবিকা নির্বাহ করে। এবং এই অঞ্চলের মানুষজনের বিদেশ যাবার হার মারাত্মক, এবং প্রথম পছন্দ তাদের মধ্যপ্রাচ্য। কুয়েত,সৌদি,কাতার,দুবাই ফেরত পাত্র এখানে সবচে দামি। এখানে অধিকাংশ পুরুষের গলার সোনার চেইন,সোনা রঙের ঘড়ি,এবং বাড়িতে বিদেশী জায়নামাজ। এখানকার মানুষের কাছে এখনও বিদেশ মানে টাকার কাড়ি,গাড়ি,বাড়ি আর ভালো বিয়ের সম্বন্ধ।

তুষখালির আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হোল ধানখেতে মাছ চাষ,বিভিন্ন রকম কার্প মাছ,রুই মাছের চাষ করা হয়। অনেক সময় জোয়ারের পানি অধিকবৃষ্টিতে ফুলে উঠে ঢুকে পড়ে খেতে, সাথে,কাঁকড়া,মাছ,সাপ আর ব্যাঙ। তখন এখানকার মানুষরা ছাতি,টর্চ আর হাতে ছররা( বাশের মাথায় লোহার কাটা বসানো) নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে মাছ মারতে।

বাংলাদেশে গিয়েছিলাম গত জুলাইয়ে,দু মাস ছিলাম দেশে। নিজের জন্মস্থানের প্রতি নাকি মানুষের টান থাকে প্রবল। বরিশাল থেকে বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেলাম তুষখালি। নেমেছিলাম মাছ মারতেও,সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে,ঠাণ্ডা লাগিয়ে আর ভোর রাতের দিকে জলঢোড়া সাপের কামড় খেয়ে বাসার ফিরেছি। ছোট মামি আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড হাসাহাসি করলেন, রাঙ্গাদি ( নানি) বললেন
“ ছররাটা তুলে রাখ মাচায়,সামনের বছর যখন আসবি তখন মারবি আবার”

আমি খুব ফলপ্রেমী,তুষখালির প্রতি আমার ভালোবাসার আরও একটি কারণ এটা। লিচু আর জাম্বুরা গাছ প্রায় প্রতি বাড়িতে, ফল হচ্ছে দেদারছে,সাথে আম কাঁঠাল আর পেয়ারা।
যারা একটু অবস্থাসম্পন্ন তাদের বাগানে আরও আছে ডাব,ছফেদা,জামরুল।
আর খাল পাড়ের গাব গাছের গাব সবার জন্য উন্মুক্ত। আকারে বড়,এবং মিষ্টি শাঁস ওয়ালা গাবকে বলা হয় বিলাতি গাব,আর ছোট,পানসে গাবকে বলা হয় দেশী কিম্বা প্যাঁচরা গাব।
নামকরনের সার্থকতা উদ্ধার করার চেষ্টা চালিয়েছিলাম,লোকে বলে বড় গাব আংরেজ সাহেবদের মতো দেখতে,বড়সড়,লাল টকটকে আর মিষ্টি, আর পেঁচরা গাব কষ( ক্ষারীয়) । আমি মিষ্টি হেসে আমার নিজস্ব সমর্থন জানালাম,এবং অনুভব করলাম জাতি হিসেবে নিজেদের আমরা কুৎসিত ভাবতেই পছন্দ করি।
তবে যখন সিডর আঘাত করল তখন ফল গাছ প্রায় সব মুড়িয়ে দিয়ে গেছে, এখনও বেচারারা আগের রূপ যৌবন ফিরে পায়নি।

ইতিহাস

আমার নানা আর নানির কথা একটু বলি,নানা গত হয়েছেন। ক্যান্সার বাসা বেধেছিল শরীরে। নানা যখন মারা যান আমি তখন বেশ ছোট,বুঝতে শিখেছি মাত্র। এতটুকু বুঝেছিলাম নানা আর নেই,মসজিদের পাশে উচু ঢিবির নাম কবর,নানা সেখানে শুয়ে আছেন,আমার মা কাদছেন অতএব আমারও কাদা উচিত।
আমার নানা খুব সুদর্শন পুরুষ ছিলেন। পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সে স্টুয়ার্ড ছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার আগের মাসে তিনি করাচী ত্যাগ করেন গোপনে,চাকরি থেকে ইস্তফা না দিয়েই। আমার মায়ের বয়স তখন ২ মাস। বাচ্চা ছোট তাই যুদ্ধে যেতে পারেননি পারিবারিক কারনে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নানা আশে পাশের অনেক হিন্দু বাড়ির মেয়েদের নিজের ধানের গোলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। এলাকায় নানার প্রচণ্ড সুনাম।

শেষ বয়সে একবার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চেয়েছিলেন,কি সব কারনে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করা হয়ে ওঠেনি নানার। দেশ স্বাধীন হবার পর নানা পরিবার পরিকল্পনা অফিসার হন। চাকরি করেছেন দেশের বিভিন্ন জায়গায়। মায়ের মুখে শুনেছি আমার নানা আমার নানিকে বিয়ে করবার জন্য ৭ দিন নানী বাড়ির কাছারিতে ( বসার ঘর) অপেক্ষা করেছেন,নানির বাবা শেষ পর্যন্ত এই নাছোড়বান্দা যুবকের হাতেই তার মেয়ে তুলে দেন।
নানীর বাড়ি তুষখালি থেকে নৌকায় ৬ ঘণ্টা ( যখন গিয়েছিলাম তখন নৌকায় গিয়েছিলাম,সড়ক পথের দূরত্ব জানা নেই আমার) জায়গাটার নাম চিত্রা। অসম্ভব সুন্দর এক গ্রাম,একবারই যাবার সুযোগ হয়েছিল চিত্রায়। নারিকেল গাছ থেকে নামার সময়ে আমার বুকের ছাল ছড়ে গিয়েছিল,তখন মা সহ ফিরে আসতে হয়েছিল চিত্রা থেকে।

আমার মা যখন সন্তান সম্ভবা তখন নানা নানি তাকে তুষখালি নিয়ে যান,এটা সম্ভবত আমাদের দেশের একটা ট্রাডিশন। কথা ছিল মে মাসের মাঝের দিকে মেজ মামা মাকে নিয়ে বরিশালে ফিরবেন, সেখানে বরিশাল মেডিক্যাল কলেজে আমার জন্ম হবে,বাবার চাকরিও তখন বরিশাল এবং আমার এক ফুপিও বরিশালে মায়ের জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত মায়ের আর যাওয়া হোল না বরিশাল,আমি জন্ম নিলাম তুষখালিতে। যে বিছানায় মা আমাকে প্রসব করেছেন,সেই খাটটা এখনও আছে,হাত বুলিয়ে দেখেছি,যদিও জন্ম অনুভব করতে পারিনি।

নানা বড় অফিসার হওয়াতে তিনি আমার জন্মের সকল আয়োজন সম্পন্ন করেছিলেন সঠিকভাবে। তখন তার চাকরির পোস্টিং নড়াইলে,সেখান থেকে চলে এসেছেন তুষখালিতে। মঠবাড়িয়া হাসপাতালের ডাক্তার মাকে দেখে যাচ্ছেন নিয়মিত সপ্তাহে একবার করে,ঘোষণা দিয়েছেন কোন রকম অস্রপচার ছাড়াই মা সন্তানের জন্ম দেবেন। মাঝে একবার মাকে এসে দেখে গেলেন ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজি। উনি বিএনপি সরকারের সাংসদ,এবং ফ্রি চিকিৎসা করার কারনে তুষখালি মঠবাড়িয়াতে প্রচণ্ড প্রিয় ব্যক্তিত্ব। ডাঃ রুস্তম আলি ফরাজী আমার নানির খালাতো ভাই। মাকে দেখার পর তিনি আরও কিছু গরিব রোগী দেখেন,এবং ওষুধ লিখে দিয়ে যান।

মে মাসের ২৫ তারিখ সকাল থেকে মায়ের প্রসব বেদনা শুরু হয়,ভোর ৬ টার সময়ে। সাথে সাথেই ডাক্তার ডেকে আনতে মঠবাড়িয়া শহরে চলে যান কয়েক বাড়ি পরের মফাজ্জল নানা আর সাথে আমার মেজ মামা। তিনি তখন বেকার,মসজিদে আজান দেন পাঁচ বেলা,আর সন্ধ্যায় মাছ বাজারে গিয়ে জুয়া খেলেন।
যাই হোক,সেই সাথে নানি ডেকে আনেন আমেনা খালাকে। তিনি আগে পরিবার পরিকল্পনা অফিসে চাকরি করতেন,স্বামী মারা যাবার পরে ছেড়ে দিয়েছেন চাকরি। তার এক ছেলে ঢাকা থাকে,ব্যবসা করে এবং তাকে টাকা পাঠায়। আমেনা খালা ছাড়া তখন তুষখালিতে আর কেউ ইঞ্জেকশন দিতে পারতো না,তাই লোকে তাকে বেশ সম্মান করত।
ডাক্তার আসলেন,আমেনা খালা আসলেন,আমার ছোট মামা,মেজ মামা নানা আর নানি।

দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার,বেলা ১২ টা ৪৫ মিনিটে আমার জন্ম হোল। আমেনা খালা আমাকে কোলে নিয়েছেন সবার প্রথমে,তার পর নানি। নানির হাত থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিয়েছেন মেজ মামা। মাতৃগর্ভ থেকে বেড়িয়ে প্রথম চুমু পেলাম মেজ মামার কাছে,এবং তখনও আমাকে পরিষ্কার করা হয়নি। আমার মাও ধাতস্থ হয়ে এসেছেন অনেকটা। মায়ের পাশে শুয়ে আছি আমি,পাশে মামারা। জন্মদানের পর আমার মায়ের কি অনুভূতি হয়েছিল জানতে চেয়েছিলাম। মা বলেলেন
“ আমার মনে হয়েছে আমি বড় একটা গোলাপ ফুল প্রসব করেছি।”
বেশ বড়সড় আকারে জন্ম নিয়েছিলাম ওজন ছিল ৯ পাউন্ড। এই জন্যই হয়ত মায়ের এই অনুভূতি। আর সব মায়ের কাছেই তার সন্তান সুন্দর। বরিশালে একটা প্রবাদ প্রচলিত আছে
“হউলের পোনা,চ্যাঙের পোনা
যার রক্কে হের হোনা”
অর্থ- শোল মাছের পোনা অথবা টাকি মাছের পোনা, নিজেদের পোনা তাদের কাছে সোনা।

দেখতে কার মতো হয়েছি তখনও বলা যাচ্ছে না,সবাই উদঘাটন করার চেষ্টা চালাচ্ছে। মধ্যে কে যেন বলল রঙ হয়েছে নানার মতো,আমার নানা দুই গাল প্রশস্থ হাসি নিয়ে বারান্দায় বসলেন,এবং ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে চা ও নাশতার দিকে মনোযোগ দিলেন,সাথে ছেড়ে দিলেন উচ্চস্বরে রেডিও, পাকিস্তান থেকে আনা রেডিও। তখন বাংলাদেশ বেতারের যুগ। নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে বেতারে চলছে আবৃতি “ বল বীর……………… শিখর হিমাদ্রির”

অভাগা আমি তখন শুয়ে আছি,আমার কানে আজানের আগে ঢুকল বিদ্রোহী কবিতা। যখন বেতারে জহুরের আজানের ঘোষণা দেয়া হচ্ছে তখন সবার টনক নড়ল,খোজ পাঠানো হোল মফাজ্জাল নানার। তিনি তখন পুকুর ঘাটে গোসল করছেন। উনি এলেন এবং আমার কানে আজান দিলেন। কিন্তু কি লাভ!! সর্বনাশ যা হবার তো হয়েই গেছে।

ডাক্তার হিমেল সরকারকে ২০০০ টাকা নিতে বললেন আমার নানা,কিন্তু হিমেল সরকার কোন ভাবেই টাকা স্পর্শ করে দেখেননি। বহু চেষ্টা করা হয়েছিল। পরে আমার নানি তার একখানা জামদানি শাড়ি উপহার দেন ডাক্তার হিমেলকে। বিবাহিত ডাক্তার সেই উপহার ফিরিয়ে দেননি।
কে জানত আমার জন্ম,জন্ম দিয়েছিল আরও একটি কাহিনীর,যার সূচনা সেই দিন থেকেই।
সে কথায় পরে আসছি, জন্মের পর মিষ্টি বিতরণ, শোনা যায় আমার নানা আশে পাশের ৪০ ঘর পর্যন্ত মিষ্টি বিলিয়েছিলেন,কারণ ইসলামে বলা আছে ৪০ ঘর পর্যন্ত সবাই প্রতিবেশী। কাহিনীর সত্যতা জানা জায়নি,কারণ অনেক ঘরই এখন আর নেই,যাদেরকে জিজ্ঞাসা করেছি সবাই হেসে বলেছে “ তোমার জন্মের মিষ্টি খাইচি গেদু (বাচ্চা/বাবু)”

আমার বাবা তখনও আমার জন্মের কথা জানেন না,বেচারা অপেক্ষা করছেন আমার মায়ের ফেরার। তখন লঞ্চ এবং স্টিমার উভয় চলত,সেখানে সারেং এর মাধ্যমে মিষ্টি আর খবর পাঠানো হোল আমার জন্মের। পরের দিন সকালে ঢাকা থেকে এসে উপস্থিত হলেন আমার বড় ফুপি এবং ফুপা। তাঁরা অবশ্যই আমার জন্মের খবর জানতেন না,মাকে দেখতে এসেছন। বড় ফুপা নিয়ে এসেছেন এক কুড়ি ইলিশ মাছ আর এক কার্টুন কমলা। আমার রূপ চেহারা দেখে বড় ফুপি খুব মুগ্ধ হলেন,নিজের গলার চেইন খুলে আমার গলায় পড়িয়ে দিয়েছিলেন।
কোলে নিয়ে ফুপি আমাকে সারা বাড়ি হেটেছেন আর বলেছেন “ মনু তুই এত শাদা,তুই গিরিবাজ কইতরের লাহান শাদা”

আমাকে মা যখন এই কথা বলেন আমাকে বলেন,আমি প্রশ্ন করি “ শাদার মাহাত্ত বুঝলাম না আম্মু”
মা বলেন তিনি দেখতে শ্যামলা ছিলেন,এই জন্য সবার ধারনা ছিল বাচ্চাও কালো হবে,কিন্তু যেহেতু আমি ফর্শা হয়েছি এই জন্য সবাই মাত্রাতিরিক্ত খুশি হয়েছে। আর সেই সাথে প্রথম সন্তান ছেলে,এটা আলাদা একটা গর্ব। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক পুরুষই এক একটা ট্রাম কার্ড। আমার হিসাবই বা তার বাইরে হবে কেন?

টুইস্টিং রোমান্স

এখন আবার একটু পেছনে ফিরে যাচ্ছি
একটা বড় খাওয়ার আয়োজন করা হোল নানাবাড়িতে, মূল উদ্দেশ্য ডাক্তারকে খাওয়ানো,এবং সেই সাথে নিজেরা ভালো মন্দ খাওয়া। গরু গরু রব উঠলেও শেষমেষ দফা রফা হয় খাশিতে। কারণ ডাক্তার হিমেল গো মাংস ভক্ষন করেন না।
খাশি জবাই করলেন মফাজ্জল নানা,চামড়া ছিলেছেন আমার নানা নিজে,বিকালের দিকে আসলেন ডাক্তার সাহেব। আমেনা খালা চলে এসেছিলেন সকাল সকাল, নানিকে পিঠা বানাতে সাহায্য করেছিলেন। মূল খাওয়া দাওয়া শুরু হয় সন্ধ্যার পর, বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল এই ভোজনপর্ব শেষ হতে। নানি টিফিন কেরিয়ারে করে মাংশ আর পিঠা দিয়ে দিলেন ডাক্তারকে। রাস্তায় অন্ধকার তখন,হ্যাজাক দিয়ে ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আসতে চাইলেন আমার নানা। কিন্তু
আমেনা খালা বললেন তার কাছে টর্চ আছে, ডাক্তার সাহেবকে তিনি বড় রাস্তায় ছেড়ে,সেখান থেকে বাসায় ফিরবেন। খুবই উত্তম প্রস্তাব।
ছোট্ট ঘটনাটার সূচনা এখানে,সেই রাতে আর বাসায় ফিরে যাননি ডাক্তার সাহেব। বড় রাস্তায় বা বাজারেও তাকে কেউ দেখনি সেই রাতে,বরঞ্চ দেখেছে পরদিন কাক ডাকা ভোরে।

এর পরে তাদের দীর্ঘদিনের প্রেম চলেছে,ডাক্তারের স্ত্রী থাকতেন তার গ্রামের বাড়িতে। আমি আমার মা না থাকলেও তখন তুষখালিতে ডাক্তারের আসা পড়ত সপ্তাহে কমপক্ষে দু বার। সেইদিন গুলোতে আমেনা খালা ভালো মন্দ রান্না করেন,রসের পিঠা বানান।
সেই পর্যন্ত সেই ভালোবাসা তিক্ততায় পরিনত হয়, আমেনা খালা ডাক্তারের সাথে ঘর বাধতে চান, ডাক্তার বার বার বুঝিয়ে বলতে থাকেন আমেনা খালাকে,শেষ পর্যন্ত আমেনা খালা এলাকার কয়েকজন শাণ্ডা পান্ডা দিয়ে ডাক্তারকে চাপ প্রয়োগ করেন।

ডাক্তার তুষখালিতে ৩ কানি ধানী জমি কিনেছিলেন,তিনি আমেনা খালাকে সেই জমি লিখে দিয়ে মঠবাড়িয়া ত্যাগ করেন। আর কোনদিন তিনি ফেরেননি পিরোজপুর জেলার আশে পাশে।

ভিজিটিং আমেনা খালা

গত জুলাই মাসের শেষের দিকে এক প্যাকেট মিষ্টি আর একটা শাড়ি নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলাম আমেনা খালার সাথে। খালা এর আগে সব সময় নিজেই আমাকে দেখতে আসতেন,যতবার মামা বাড়ি গিয়েছি ঠিক ততবারই।
আমেনা খালা আমাকে দেখে খুবই খুশি হন,সেই সাথে বিদেশে থাকি জেনে তার হাসি ছড়িয়ে পড়ল। আমারে লেবুর শরবত আর আম কেটে দিলেন খেতে, তার কাছ থেকেই উপরোক্ত অনেক ঘটনা শোনা।

তিনি খুব রসিক কথাবার্তা বলেন। এই যেমন আমি নাকি ছোট বেলায় তার তোষকের নীচ থেকে কনডমের প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম,তারপর কনডম এর মধ্যে বাতাস ফুলিয়ে অন্য বাচ্চাদের সাথে সেই বেলুন নিয়ে খেলা করেছি। শুনে আমার কান লাল হয়ে গিয়েছিল,আর খালা তখন খিক খিক করে হাসছেন। আমি সাহস করে ডাক্তারের কথা তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,তিনি হেসে বললেন “ জাইন্না তুমি কি করবা গেদু?” আমি বললাম এমনিতেই জানতে চাচ্ছি।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন
“ প্রেমের ফাদ পাতা এ ভুবনে
কে কোথায় কখন ধরা পরে কে জানে!!”
খালার জন্য যে আমার সহানুভূতি উপচে পড়েছিল এটা বলব না,কিন্তু খারাপ লেগেছিল,কারণ তিনি সব জেনেই ডাক্তারমুখো হয়েছিলেন।

খালা আমাকে অনেক প্রশ্ন করেন, আমি উত্তর দিতে চেষ্টা করি,কিছু উত্তর হয়ত জানি কিছু হয়ত জানি না। খালা বলেন “ তোমার চোখে তো রঙ লাগছে গেদু,শাদা সোনার রঙ”
আমি বুঝতে না পেরে মানে জিজ্ঞাসা করি । খালার সরাসরি উত্তর “ বিদেশী মাইয়াগো শাদা বুনি খাইছ গেদু,এখন কি আর দেশী বুনি স্বাদ লাগবো?”

উত্তর না দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে ভেবে আমি চুপচাপ বসে থাকি। খালা আরও বলেন ইসলামের ইতিহাসের কথা,যখন মুসলমানেরা দুনিয়া শাসন করেছেন তখনকার সময়ের শান্তির কথা। আমি হাই তুলে খালার কথা শুনি। বিদেশী মেয়েরা নাকি কুকুরের মতো পুরুষ বদলায় এমন প্রশ্নে আমি খালাকে কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারি না। আমি বোঝাতে পারি না যে সেখানের সমাজ ব্যবস্থা আর আমাদের সমাজ সম্পূর্ণ আলাদা,আমি বোঝাতে পারিনা,সেখানে মেয়েদের গায়ে হাত তুললে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়,সেখানে মেয়েরা পুরুষের মতো কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে,আয় করে,সন্তান পালে। আমি বোঝাতে পারিনা সেখানের মেয়েদের ইচ্ছা স্বাধীনতা আছে।
খালা আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে ফেলতে থাকেন,খালা বলেন যারা রাস্তায় চুমু খায়,পুরুষের হাত ধরে রাস্তায় হাতে,ছোট কাপড় পড়ে তাদের আবার কিসের সমাজ? কিসের ধর্ম?

আমি ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসি, পরাজিত আমি। কুশিক্ষার কাছে যুক্তির মূল্য যেখানে শূন্য।

মফাজ্জল নানা বচন

এরপর আমি শাদা লুঙ্গি আর মিষ্টি নিয়ে দেখা করতে যাই মফাজ্জল নানার সাথে। তিনি সদ্য শ্বশুর হয়েছেন,তাই শাদা লুঙ্গি। এই বুদ্ধি দিয়েছেন আমার ছোট মামা,তিনি আবার খুব সংসারি মামা, মালয়শিয়া ছিলেন দীর্ঘদিন,ফিরে এসে ঘোষণা করেছেন “ নানা,তাকে স্বপ্নে বলেছেন তালুকদার বাড়ির মেয়ে সীমাকে বিয়ে করতে” স্বপ্ন আর নানার কথা শুনে সবাই চট জলদি মামার বিয়ে ঠিক করে সীমা মামির সাথে। তখন কারো মনে ছিলনা যে এই সীমা মামিকেই মামা স্কুল জীবনের শেষ ভাগে আর কলেজ জীবনের প্রথমভাগে অনেক চিঠি লিখেছিলেন। বানান ভুলের কারনে মামি অধিকাংশ চিঠি আবার ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এবং মামি এখনও সেটা গর্ব করেই বলেন। অবশ্য মামি ইন্টার পরীক্ষায় পাশ না করতে পারার পর মামাও তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তিরস্কারের দাত ভাঙা জবাব দেন।

যাই হোক মজাজ্জল নানা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরেন,বলেন আমার চেহারা খারাপ হয়ে গেছে,ছোট বেলায় আমি একদম পোটকা মাছের মতো মোটাসোটা ছিলাম। সেখানে মফাজ্জল নানার বউ নিয়ে আসলেন ডাবের পানি আর চিড়ার মোয়া। ডাক্তারি পড়ছি শুনে মফাজ্জল নানা হুংকার দিলেন “ বউ,আমার ডাক্তারের কাগজটা নিয়ে আসো দেখি”
মিনিট খানেক পর কাগজ নিয়ে আসলেন মফাজ্জল নানার পুত্রবধু,আমার মতো ধামড়া একটা ছেলে হাফ প্যান্ট পড়ে লোমশ পা বের করে বসে আছে এটা দেখেই মাথার ঘোমটা লম্বা করলেন পুত্রবধু,আমার হাতে কাগজ দেবার সময় চোখাচুখি হোল তার,আমি বুঝলাম বউ ট্যাঁরা।

আমি নানাকে বললাম ডাক্তারের দেয়া ওষুধ নিয়মিত খেতে। কারণ আমি এখনও পেস্ক্রিপশন বোঝার মতো পড়াশুনা শেষ করিনি। এর পর তার জীবন কেমন চলছে জানতে চাইলাম। নানা একসময় মসজিদের ইমাম হয়েছিলেন, দীর্ঘদিন তিনি রাজত্ব করেছেন এলাকার মসজিদে। কিন্তু বিপত্তি বাধায় এলাকার এক হজ করে ফেরা আলেম, এক শুক্রবারের জুম্মার নামাজের পর তিনি সবার সামনে প্রশ্ন করেন “ সূর্যগ্রহন ও চন্দ্রগ্রহনকালীন নামাজের নাম কি ইমাম সাহেব?”
মফাজ্জল চাচা দীর্ঘ নীরবতার পরে বলেন তিনি এই প্রশ্নের উত্তর জানেন না। এর পরে থেকেই মুলত নতুন ইমামের আগমন,নতুন ইমামকেও একই প্রশ্ন করেন হজ ফেরত আলেম।
নতুন ইমাম মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় “ সূর্যগ্রহনকালীন নামাজের নাম “সালাতিল ক্যুসুফি” এবং চন্দ্রগ্রহণকালীন নামজের নাম “সালাতিল খুসুফি”

হজ ফেরত আলেম সম্মতি জানান,এর পর এলাকা জুড়ে হজ ফেরত আলেম এবং নতুন ইমামের দ্বীনের সুনাম ছড়িয়ে পরে। যদিও মফাজ্জল নানা মনে করেন এই উত্তর আলেম আগেই ইমামকে শিখিয়ে দিয়েছিল। তা ছাড়া এই তথাকথিত আলেম হজে যাবার আগে অনেক খারাপ মানুষ ছিলেন। আমি জানতে চাইলাম কেমন খারাপ মানুষ?
মফাজ্জল নানা উত্তর দিলেন,এই আলেম মদখোর ছিলেন,আর পোলাখোর। ওনার কাঠ বিক্রির ব্যবসা,কাঠের গুদামের পাশে অফিস,সন্ধ্যার পর তিনি অফিসের দোতালায় বসে আকণ্ঠ মদ খান এবং বিভিন্ন জায়গা থেকে বাচ্চা ছেলে ভাড়া করে এনে নাচান। পোলাখোর শব্দটার মানে বুঝতে না পেরে আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম।
মফাজ্জল নানা বললেন ” হালার পুতে পোলা খেলায়,পোলা ধইরা আইনা হোগায় দেয়।” মফাজ্জল নানার কথা থেকে আমি বুঝতে পারলাম হজ ফেরত আলেম সাহেব শিশুকামী এবং বিকৃত রুচির।

মফাজ্জল নানা আরও বলেন হজ করলেই আলেম হওয়া যায় না। এই এলাকায় মফাজ্জল নানার বাবা ছিলেন প্রকৃত আলেম,তিনি ছিলেন বোম্বাই হাজি। তখনকার সময়ে যারা হজে যাবার মনস্থির করে ঘর ছাড়তেন কিন্তু বিভিন্ন কারণ বশত বোম্বে শহর থেকে ফিরে আসতেন তাদের বলা হয় বোম্বাই হাজি। তখনকার সমাজে বোম্বাই হাজিদের খুব কদর এবং খাতির করা হত।

মফাজ্জল নানা এখন আছেন ভালই,শহরের উপরে একটা পাকা মার্কেট করেছেন,দোতালায় আওয়ামীলীগের অফিস,নীচে ভাতের হোটেল আর সিডি ভিসিডির দোকান। ভাড়া দিয়ে বেশ চলে যায় তার। তবে ইদানীং একটু টেনশনে আছেন,তার ছেলের দুবাই যাবার বিষয়ে এক দালালকে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন, দালাল আজ বলে এই ঈদে পাঠবো,কাল বলে কোরবানির ঈদের পর।

ছেলের বউ খুব ধার্মিক, গুদিকাঠা নামক এক জায়গার এক নামী পীরের মুরিদ। তবে মফাজ্জল নানার বউয়ের সন্দেহ তার পুত্রবধু বাঁজা মেয়েমানুষ। প্রায় ৮-৯ মাস হয়েছে বিয়ের এখনও কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
আমি বললাম,হয়ত তাঁরা ইচ্ছে করেই বাচ্চা নিচ্ছে না,মাত্রই তো বিয়ে হোল। আমাকে বলা হোল নানার ছেলে নিতে চাচ্ছে বাচ্চা,কিন্তু হচ্ছে না। অতএব বউ বন্ধ্যা।
আমি বললাম নানি,হয়ত মামার( নানার ছেলে) সমস্যা থাকতে পারে,ডাক্তার দেখালে এবং টেস্ট করলে বোঝা যাবে,কোনটা সঠিক। স্বামী স্ত্রী আমাকে নিয়ে খুব একচোট হেসে নিলেন। আমি হাসি শেষ হবার অপেক্ষায় থাকলাম। হাসি শেষে নানি বললেন
“মুরোদের পো মুরোদ হয় বুঝালা গেদু, আর বউয়ের বড় বোনের বাচ্চা হয়না,ধুমসি বুড়ি হয়ে গেছে,দুই বুইনের একই সমস্যা মনে হইতাছে”
আমি নতুন অনেক কিছু জেনে,শিখে চলে আসলাম।

শেষাংশ

এই মানুষগুলোর হাতেই আমার জন্ম হয়েছিল,আজ একটু স্মৃতিচারণ করলাম তাদের নিয়ে, আমার জন্ম তাদের কাছে হয়ত আরও ১০ টা সাধারন শিশুর মতই সাধারন, কিন্তু আমার কাছে এই মানুষগুলো অসাধারণ। তাদের কথা শুনতে আমার ভালো লাগে,জানতে ভালো লাগে তাঁরা কেমন আছে,কিভাবে বেঁচে আছে।
আবার আমি দেশে গিয়ে এদের সাথে দেখা করবো, আবার আমার জন্মের গল্প শুনবো। আমার সামনের বছরের জন্মদিনে আবার হয়ত এই লেখাটা বের করে পড়ব,তখন আবার আমার রক্তে রক্তে বইবে আমার জন্মস্থান,এই প্রিয় মানুষগুলি।

উলঙ্গ রাজারা


যে কারনে লিখছি,সেটা হোল সংসদে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে নিয়ে উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় এবং তার বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন।

ব্যক্তিগত ভাবে সায়ীদ স্যারকে আমি খুবই সম্মান করি,উনি একটি বইপড়া মুক্তচিন্তা করতে পারা জাতি চান। প্রমথ চৌধুরীর একটা লাইন মনে পড়ে,তিনি বলেছিলেন হাসপাতালের থেকেও গ্রন্থাগার জরুরী। পক্ষে বিপক্ষে যদিও অনেক কথা চলে,তবু গ্রন্থাগারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য।
সায়ীদ স্যার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাপতি। তিনি যে কাজ হাতে নিয়েছেন,যে আলোর পথে মানুষকে আনছেন বলাই বাহুল্য যে উহা মহান।
সায়ীদ স্যার এর যে একটা লাইন আমাকে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করে যায় সেটা হোল
“ মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়।“

যাই হোক আমাদের নির্বাচিত সাংসদেরাও মহান,গণতন্ত্রের বাহক। জনগনের ভোটে নির্বাচিত হয়ে তারা ক্ষমতায় এসেছেন। সংসদ অধিবেশনে তাহারা বিভিন্ন বিল পাশ করে নিয়মিত দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করছেন।
অধিবেশনে এই ঘটনার সূত্রপাত করেন সাংসদ ফজলুল আজিম। তিনি অবশ্য আগে ভাগেই এমন হুংকার দিয়েছেন,মন্ত্রী এমপিরা জাতির বাপ মা,এদের না খেপানোই মহৎ ও সমীচীন।

তিনি সংসদে একটি মহা উৎকর্ষ সাধন করিবার অভিপ্রায়ে,নোটিশ উপস্থাপন করেন,সেখানে সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা তুলে ধরা হয়। নোটিশের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, ‘‘সবাই উত্তরা যাওয়ার সময় মাথার ওপরে (ওভারব্রিজ) দেখে শুধু ফজলুল আজিম সাহেবরা দেখেন না, ওনারা দেখে শুধু সরকারের ব্যর্থতা।
তিনি অবশ্য অর্থনীতি নিয়েও প্রচণ্ড সরব। সংসদে তার জ্বালাময়ী বক্তব্যগুলো বেশ শ্রুতিমধুর। তিনি বলেন, ‘‘অর্থনীতির সবগুলো সূচকেই আমাদের দেশের অর্থনীতির ভরাডুবি ঘটেছে। শেয়ারবাজারের পতন সর্বশেষ পর্যায়ে চলে গেছে। গত এক সপ্তাহের শেয়ারবাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়- শেয়ারবাজার একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘অথচ অর্থমন্ত্রী কিছু করতে পারেননি। অর্থমন্ত্রী একজন ভালো মানুষ। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। প্রধানমন্ত্রী যেখানে দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। সেখানে অর্থমন্ত্রী পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। এই অর্থমন্ত্রী দিয়ে কিছু হবে না।’’
ফজলুল আজিম বলেন, ‘‘আমি মনে করি, এই সংসদে যোগ্য ব্যক্তির অভাব নাই। সুতরাং দেশের অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে নিজের ভুল স্বীকার করে অর্থমন্ত্রীর স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করা উচিত। আর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এখনই ব্যবস্থা নেয়া উচিত।’’

এই সংসদে যোগ্য ব্যক্তির অভাব নাই এই লাইনের সাথে ফজলুল আজিমের মিল খুজে পেলে পাঠক দায়ী থাকবেন।

আমার এক মামা প্রায় সর্বশান্ত হয়ে গেছেন শেয়ার বাজারে টাকা খাটিয়ে। মামা বলেন “বিদ্যুৎ,আর শেয়ার বাজার ঢাকায় লীগের সব আসন খুয়াবে।“ উল্লেখ্য গত জাতীয় নির্বাচনে ঢাকার সবকটি আসনে জয় লাভ করে নৌকা মার্কা।
এই শেয়ার বাজারের ভরাডুবির কারণ খুজতে গিয়ে যদি পাঠক চুরি ও টাকা ওলট পালটের গন্ধ পেয়ে থাকেন,সেটি কাকতালীয়। আমাদের অর্থমন্ত্রী শেয়ার বাজার বোঝেনই না,অতএব সকল রকম গন্ধ পাওয়ার সুযোগ নাই।

শেখ ফজলুল করিম সাহেবের কথা বলতে গেলে তো ব্লগের কাগজ ফুরিয়ে যাবে। শেখ পরিবারের এ বীর সন্তান বহু আগে থেকেই জাতি উদ্ধার করে আসছেন।

২০০৭ সালে গ্রেফতার হন শেখ ফজলুল করিম,ও আচ্ছা তিনি একাধারে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ফুপাত ভাই। আজম চৌধুরী নামক এক ব্যবসায়ীর মামলায় গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া হয় তাকে।

রিমান্ডে থাকা আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্য মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম অকপটে স্বীকার করেছেন যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রী থাকা অবস্থায় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আংশিক কাজ থেকে তিনি ইস্টকোস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যানের কাছ থেকে সাড়ে ৫ লাখ মার্কিন ডলার নিয়েছিলেন। এছাড়া বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে প্রতি মাসে নিতেন ৩ লাখ টাকা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রীও বসুন্ধরা গ্রুপের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা করে চাঁদা নিয়েছেন বলে শেখ সেলিম জানান। (সূত্র- দৈনিক ইত্তেফাক)

অস্ত্র দেখিয়ে ডাকাত যখন ডাকাতি করে সেই ঘটনার সাথে এই ঘটনার মিল খুজে পেলে পাঠক দায়ী থাকবেন।

আজম চৌধুরী তার মামলায় বলেন, ২০০০ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী ও শেখ সেলিম স্বাস্খ্যমন্ত্রী থাকাকালে টেকনো প্রম নারায়ণগঞ্জে একটি বিদ্যুৎ প্লান্টের প্রথম ধাপটি নির্মাণের কার্যাদেশ পায়। কিন্তু আজম চৌধুরীকে শেখ সেলিম জানান যে, ‘কমিশন’ প্রদান না করা হলে শেখ হাসিনা প্রকল্পটি বìধ করে দেবেন এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে টেকনো প্রমের পাওনা পরিশোধ আটকে রাখতে বলবেন। এ পরিস্খিতিতে আজম চৌধুরী স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ও সাউথইস্ট ব্যাংকের আটটি চেকের মাধ্যমে শেখ সেলিমকে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা প্রদান করেন। শেখ সেলিমকে ২৯ মে গ্রেফতার করা হয়। তিনি আদালতে প্রকাশ্য শুনানিতে স্বীকার করেন যে, তিনি ইস্টকোস্টের কাছ থেকে দুই কোটি ৯০ লাখ টাকা আদায় করেছিলেন এবং শেখ হাসিনার সাথে তা ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (এসিসি) তদন্তকারীরা শেখ হাসিনা ও শেখ সেলিমের অ্যাকাউন্ট থেকে চেকগুলোর অস্তিত্ব পান।

জানতে ইচ্ছা করে আজম চৌধুরী কোথায় আছেন,কেমন আছেন? অবশ্য রাজায় রাজায় যুদ্ধ হলে প্রান যায় উলুখাগরাঁড়। সবাই হয়ত ভালো আছেন।

এসব রূপকথা লিখে আর কত আপনাদের মনে ব্যথা দেব? বিষয় বদলানোর দরকার।

আরেক বিদায়ী মন্ত্রী আবুল হোসেন তো খুবই জনপ্রিয় মন্ত্রী। তার কথা বলতে গেলে দিস্তার পর দিস্তা ফুরিয়ে যাবে।
নিন্দুকেরা বলে তিনি নাকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খামখেয়ালীর সুযোগ নিয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। বিশ্বাস করা বা না করা আপনার নিজস্ব মতামত।
চীন সফরে তিনি অনির্ধারিত দৌড় প্রতিযোগীতায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। সেই সাথে জিতে নেন মন্ত্রী গদিও। ( হাততালি এবং মারহাবা ইমো)
আবুল হোসেন সাহেবের মেয়েও অবশ্য কম যায় না। পাকি প্রেমের জলন্ত উদাহরন দিয়েছেন মেহেরজান চলচিত্রের মাধ্যমে আবুলের মেয়ে রুবাইয়েত হোসেন।উনি বলছেন ছবিটা দর্শকরা নাকি গ্রহন করছে। পাকি প্রেম আর কাকে বলে। সরকারকে অবশ্যই তদন্ত করতে হবে এই আবুল হোসেন সেন্সরবোর্ডকে কত উপটৌকন দিয়ে ছবি রিলিজ করেছে।সরকারের টনক না নড়লে তার খেসারত আমাদের সকলকেই দিতে হবে।মুক্তি যুদ্বের হাজার করুন এবং আনন্দের ঘটনা থাকতে আবুল তনায়া আমাদের বীরঙ্গনাদের এবং মুক্তিযুদ্বাদের হেয় করার জন্য এই ছবি নির্মান করেছেন।

সেন্সর বোর্ডে মাটির ময়না আটকে থাকা এবং মেহেরজান এর মুক্তি পাবার মধ্যে টাকা পয়সার গন্ধ পেলে,পাঠক দায়ী থাকবেন।

তবে আবুল হোসেন সাহেব খুবই ধর্মভীরু লোক। যার প্রমান আবুল হোসেনের কাছে হিন্দুরা একটি আশ্রামের সাহয্য চাইতে আসলে মুখের উপড় বলে দেন আমি মসজিদ ছাড়া সাহয্য দেই না। ( সুবাহানআল্লাহ্‌,এবং নারায়ে তাকবির ইমো হবে)
পদ্মা সেতু নির্মান,আর সেই বিষয়ক চুরি চামারির খবর সংগ্রহ করে পড়বার দায়িত্ব পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম। আসুন আমরা সবাই নিজে করি নীতি মেনে চলি।

কাওরান বাজারে দেখা হয়েছিল সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক সাহেবের সাথে। তিনি তো জনগণকে কম খাবার পরামর্শ দিয়ে রীতিমত সেলিব্রেটি। ভাগ্যিস সংসদে এমন কোন বিল পাশ হয়নি।

ফার্মগেট-গাবতলী লোকাল বাসের ভাড়া তোলা ছোকড়াও মন্ত্রী এমপি দের চোর বাটপার বলে গালি দিয়ে থাকে। তবে পাঠক গালি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন,কারণ গাল পাড়লে মামলা হয়ে যেতে পারে। জুটতে পারে সংসদ অবমাননা অথবা রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা।

ডক্টর ইউনুসকে নিয়ে কে কাটা ছেঁড়া হোল সেটা দেখলে আমাদের এনাটমি ল্যাবের বহুবার ব্যবচ্ছেদিত লাশও লজ্জা পাবে।

মন্ত্রী এমপি সংসদ আমাদের গনতন্ত্রের ধারক সমূহ,এদের অপমান করা থেকে বিরত থাকুন।

হুট করে মনে পড়ল শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এর কথা। তিনিও মাথায় রাষ্ট্র দ্রোহের মামলা নিয়ে মারা গিয়েছিলেন। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অভূতপূর্ব আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন।এরপরের ঘটনা বড়ই নির্মম !তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যায়। একদিকে রাষ্ট্রপক্ষ তাদের রাজনৈতিক বান্ধব দলের মানুষরুপী পশুদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া, অন্যদিকে রাস্ট্রপক্ষের মদদপুষ্ট হয়ে সরাসরি আক্রমন করে বসে ৭১ সালের হায়েনাদের দল- গোলাম আযম নিজামী গং। জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে মামলা হয় রাষ্ট্রদ্রোহীতার।অবশেষে, রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা মাথায় নিয়েই আমাদের জননী জাহানারা ইমাম ২৬ জুন ১৯৯৪ সালে দেশের বাইরে মিশিগানে ইন্তেকাল করেন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গণআদালত সংগঠিত করার দায়ে বিএনপি সরকারের দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা নিয়েই জাহানারা ইমাম মারা যান।
গুণীজন আর রাষ্ট্র এক জিনিস নয়। গুণীজণের গুনের বহর বিবেচনার ক্ষেত্র রয়েছে,এমপি,মন্ত্রীদের সাথে লাগতে গেলে গুনের বহর কেটে মামলা,আর নিন্দা লেখা হয়ে যাবে।

বহু ফিরিস্তি দিলাম,ফিরিস্তি দেখে নিশ্চয় পাঠক বিরক্ত? তাই এবারে একটু আনন্দ লাভ করুণ,পড়ুন একটি কবিতা। কবিতার নাম উলঙ্গ রাজা,লিখেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। আমাদের মনে রাখতে হবে রাজা রাজাই,সে উলঙ্গ হোক অথবা বোরখা মোড়া। তার শরীরে কাপড় না থাকলেও আমাদের ভেবে নিতে হবে রাজ প্রাসাদের মসলিন কাপড় খুব বেশি মিহি। তাই শরীর দেখা যাচ্ছে। ঢাকাই মসলিন কাপড় যদি ম্যাচ বাক্সের মধ্যে ভাজ করে রাখা যায়,রাজাদের মসলিন কাপড়ের জায়গা হয়ে যাবে আরও ছোট কোন জায়গায়।

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।
সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!
কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;
কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;
কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ
কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক;
কেউ ভাবছে, রাজবস্ত্র সত্যিই অতীব সূক্ষ্ম , চোখে
পড়ছে না যদিও, তবু আছে,
অন্তত থাকাটা কিছু অসম্ভব নয়।

গল্পটা সবাই জানে।
কিন্তু সেই গল্পের ভিতরে
শুধুই প্রশস্তিবাক্য-উচ্চারক কিছু
আপাদমস্তক ভিতু, ফন্দিবাজ অথবা নির্বোধ
স্তাবক ছিল না।
একটি শিশুও ছিল।
সত্যবাদী, সরল, সাহসী একটি শিশু।

নেমেছে গল্পের রাজা বাস্তবের প্রকাশ্য রাস্তায়।
আবার হাততালি উঠছে মুহুর্মুহু;
জমে উঠছে
স্তাবকবৃন্দের ভিড়।
কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভিতরে আজ কোথাও দেখছি না।

শিশুটি কোথায় গেল? কেউ কি কোথাও তাকে কোনো
পাহাড়ের গোপন গুহায়
লুকিয়ে রেখেছে?
নাকি সে পাথর-ঘাস-মাটি নিয়ে খেলতে খেলতে
ঘুমিয়ে পড়েছে
কোনো দূর
নির্জন নদীর ধারে, কিংবা কোনো প্রান্তরের গাছের ছায়ায়?
যাও, তাকে যেমন করেই হোক
খুঁজে আনো।
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।
সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:
রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

৭১ এর জেনোসাইড(পাক সেনাবাহিনী)


খাবার পেলে প্রথমেই সবল ঝাঁপিয়ে পড়ে,ছিঁড়ে খুড়ে খায় আর দূর্বল দূরে দাড়িয়ে দেখে। সবলের উদর পূর্ণ হলে সবল ঢেঁকুর তোলে আর দূর্বল মাঠে নামে,এর পর আস্তে আস্তে আসে আরো শক্তিহীনেরা।
মৃত হরিনের বুক খাবলে বাঘ যখন চলে যায় তখন খেকশিয়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে,খেকশিয়ালও যখন চলে যায় তখন আসে কাক,চিল,শকুন।
বাংলাদেশ নামক এই ছোট পাখিটার বুক খামচে খেয়েছে শাসকেরা কয়েক দফায়। প্রথমে খেয়েছে আংরেজ সাহেবেরা,এর পর খামচে খেয়েছে পাকিস্তানী শাসক, সেনা আর তাদের দোসরেরা।

বাংলাদেশে যখন সেনা মোতায়ন করা হয় ১৯৭১ সালে,তখন তাদের গনহত্যার আদেশ দিয়েই পাঠানো হয়,এবং সাধারন সৈনিকও বুঝে ফেলে এই মিশনে এবং এর পরবর্তীতে তাদের কোন জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। আর সেই সাথে প্রতিপক্ষ হিসেবে পেয়েছে নিরীহ,নিরস্ত্র বাঙালীকে,বিজয় নিশ্চিত ভেবেই হিংস্র ও অমানুষিক হয়ে ওঠে পাক সেনারা।
মাও সে তুং এর একটা বিখ্যাত কথা আছে ” বন্দুকের নলই সকল ক্ষমতার উৎস”। ১৯৭১ সালে পাক সেনাদের হাতে ছিল অস্ত্র আর ম্যাসাকারের আদেশ,হাতে অস্ত্র থাকলে মানুষের শরীরে নাকি অদ্ভুত এক ক্ষমতার আবেশ চলে আসে,ব্যতিক্রম হয়নি ১৯৭১ সালেও। সেনারা হাসতে হাসতে আগুন দিয়েছে গ্রামে,বেয়োনেটে গেথেছে শিশুকে,মায়ের কোল থেকে শিশুকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে আগুনে।
সারা বাংলাদেশের নারীকে করছে রেপ,শুধু রেপ করেই ক্ষান্ত হয়নি হায়েনার দল,দু পায়ের মাঝে বেয়োনেট ঢুকিয়ে হত্যা করেছে,স্তন কেটে নিয়েছে,খোলা মাঠে নগ্ন নৃত্য করাতে বাধ্য করেছে।
৭১ এর জেনোসাইড নিয়ে লেখা এই পর্বে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি তৎকালীন গণহত্যার সাক্ষী কিছু মানুষের বক্তব্য,কিছু বই ও আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের অংশবিশেষ।

এন্থনি মাসকেরহানস
The rape of Bangladesh
পৃষ্ঠা- ১১৬-১১৭

বাংলাদেশের উপরে চালানো গণহত্যার লক্ষ্য নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। মূলত তারা ছিলেন
১) বাঙালী সৈনিকেরা,যারা কর্মরত ছিলেন সামরিক বাহিনীতে ( ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট),পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসে,পুলিশ এবং আধা সামরিক আনসার বাহিনীতে।
২) হিন্দু জনগোষ্ঠী- কিছু কিছু সৈনিকের বক্তব্য ছিল এমন “ আমরা শুধু হিন্দু পুরুষদের হত্যা করছি,নারী এবং শিশুদের মুক্তি দেয়া হবে।“ তাদের ধারনা ছিল একজন নিরীহ ও নিরস্ত্র হিন্দু পুরুষকে হত্যার মধ্যে হয়ত গৌরব রয়েছে।
৩) আওয়ামিলীগার- সকল সমর্থক,কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ের সকল নেতা কর্মী ছিল হত্যার লিস্টে।
৪) শিক্ষার্থী- কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র ছাত্রী,এবং আন্দোলনরত কিংবা মিছিল মিটিঙে অংশগ্রহনকারী শিক্ষার্থী।
৫) বাঙালী বুদ্ধিজীবী- বিশ্ববিদ্যালয় এর শিক্ষক,প্রফেসর এবং খ্যাত ব্যক্তিবর্গ।

প্রফেসর হরিধন দাসের নিজের কিছু কথা পাওয়া যায় Genocide in Dhaka University: 1971 বইটিতে। সেখানে তিনি বর্ননা করেছেন পাক সেনাবাহিনীর বীভৎসতার কথা।

প্রফেসর হরিধন দাস
ভিক্টোরিয়া কলেজ,কুমিল্লা।
(Quoted from “Genocide in Dhaka University: 1971, The Jagannath Hall” by Prof Ratanlal Chakraborty, Dept of History, University of Dhaka)

“দরজায় ভারী বুটের আঘাত। হাত মেলানোর পর আমরা একে অন্যের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। যত জোরে সম্ভব আমরা তিনজনে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। এরপর তিনজন ঘরের তিন কোনায় ছড়িয়ে পড়লাম। আমি ছিলাম দরজার পেছনে। ভারী গুলির বর্ষনে দরজা ভেঙ্গে তছনছ হয়ে গেলো। হঠাৎ দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হল। খুনিটি বলে উঠলো, “বল জয় বাংলা,বাইনচোদ! শেখ মুজিবর কোথায়?” একটি পেন্সিল টর্চের সাহায্যে ওই ঘাতকগুলো ওদের ধ্বংসযজ্ঞ দেখে নিল। এরপর ওই দানবগুলো পরবর্তী দরজার দিকে পা বাড়াল। তাদের ওই ধ্বংসযজ্ঞ বিরতিহীনভাবে সকাল পর্যন্ত চললো। এরই মধ্যে আমার রুমে আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল।

গানপাউডারের গন্ধে আমার শ্বাসরোধ হয়ে আসছিলো। ভাঙ্গা দরজার নিচে চাপা পড়ে আমি সব কষ্ট সহ্য করছিলাম। সুশীল এবং অন্যান্য বন্ধুদের কি হয়েছে দেখার জন্য আমি বহু কষ্টে আমি ভাঙ্গা দরজার নিচ থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসলাম। ওরা কোথায়? সারা রুম হন্তদন্ত হয়ে খুঁজে আমি কিছুই পেলাম না। কিভাবে এতো পানি আর পিচ্ছিল পদার্থ এলো আমার রুমে? যেহেতু ধীরে ধীরে আমার জ্ঞান ফিরে আসছিলো আমি বুঝতে পারলাম যে ভারী গুলি বর্ষণ এবং গ্রেনেড চার্জের কারনে ওদের শরীর ঝাঁঝরা/ছিন্নবিন্ন হয়ে গিয়েছে।

ওরা শহীদ…………আমি দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারছিলাম না, মনে হচ্ছিলো আমার বাম পা শরীর থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে। আঙ্গুলগুলো অসাড় হয়ে গিয়েছিল। রক্তে এবং ক্ষতে আমার সারা শরীর ভরে গিয়েছিল। আমি আমার গায়ের হাফ হাতার শার্টটি দিয়ে পা কোনমতে মুড়িয়ে ফেললাম।
আর বারুদের শব্দ, গ্রেনেড আর মৃত্যুর আর্তনাদ……..

জন হেস্টিংস এর কিছু কলাম নিউজউইকে ছাপা হয়,সেগুলো ছিল সত্যি হৃদয়বিদারক। হেস্টিংস তার বেশ কিছু কলামে রুমেল এর তথ্যসূত্র ও বক্তব্যও ব্যবহার করেন।
John Hastings, A Methodist missionary worked in Bangladesh for 20 years.
(from Newsweek)

আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি তারা সাধারন জনগণের উপরে কি নির্মম অত্যাচার করেছে। রক্ষা পায়নি শিশুও। তারা খেলার ছলে শিশুকে ছুঁড়ে দিয়েছে উপরে,তারপরে তাকে গেঁথেছে রাইফেলের বেয়োনেটে। রক্ষা পায়নি নারীও। তারা পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে নারীকে,তারপর হত্যা করেছে দু পায়ের মাঝে বেয়োনেট গেঁথে।

এছাড়াও নিউজ উইকের আর একটি সংবাদ সবাইকে নাড়িয়ে যায় ভীষণ ভাবে। নীচে সংবাদটির অনুবাদ দেয়া হোল।

Neewsweek

লাল এবং সবুজ ফুলওয়ালা জামা পরা মেয়েটির গল্পে আছে এক আজব বীভৎসতা। সে কারো জন্য ক্ষতির কারন ছিল না। আমি ওর সাথে দেখা করেছিলাম কৃষ্ননগর, বিচলিতভাবে অন্যান্য রোগীদের মাঝে আটকে ছিল, যেখানে এক পাকিস্তানি সৈনিক তার বেয়নেট দিয়ে নির্মমভাবে খুঁচিয়ে ওর গলায় নীল ক্ষতের চিহ্ন বানিয়েছিল সে জায়গাটি হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিল। “আমি ইসমত আরা, মৃত ইশাক আলীর কন্যা” সে আমাকে ভদ্রতা করে বলছিল।

“আমার বাবা ছিলেন কুষ্টিয়ার একজন ব্যবসায়ী,প্রায় দুই মাস আগে সে বাসা থেকে বের হয় এবং তার দোকানে যায় এবং এরপর আমি আর তাকে দেখিনি। ওই একই রাত্রে আমি বিছানায় যাওয়ার পর চিৎকার এবং তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিলাম,এবং কি ঘটনা ঘটছে যখন দেখতে গেলাম তখন ওখানে পাঞ্জাবী সৈনিকেরা ছিল। আমার ৪ বোন মেঝেতে মৃত পড়েছিল এবং ওরা যখন আমার মাকে মেরে ফেলছিল তখন সেটা আমি দেখেছিলাম। আমি যখন ওখানে ছিলাম ওরা আমার ভাইকে গুলি করেছিল, সে ছিল বিজ্ঞানে স্নাতক। এরপর একজন সৈনিক আমকে দেখে ফেলে এবং তার ছুরি দিয়ে আমাকে আঘাত করে। আমি মেঝেতে পড়ে গিয়ে মৃতের অভিনয় করি। যখন ওরা চলে গেলো আমি পালিয়ে আসি এবং একজন লোক আমাকে সাইকেলে উঠিয়ে এখানে নিয়ে আসে।

হাসপাতালটি বর্ডার থেকে আধা মাইল দূরে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলাতে এবং ইতিমধ্যেই সেটা উত্তেজিত পাকিস্তানিদের শিকার অসহায় মানুষ দ্বারা কানায় কানায় পূর্ন ছিল। সেখানে ছিল পেটে গুলি লাগা সত্ত্বেও বেঁচে যাওয়া ৪ বছরের এক বালক এবং এক মহিলা যে কিনা ক্লান্তভাবে বলে যাচ্ছিলো কিভাবে পাকিস্তানিরা তার দুই সন্তানকেই তারই চোখের সামনে হত্যা করেছে এবং এরপর তাকে গুলি করে যেহেতু তার ছোট বাচ্চাটি তার কোলে ছিল। “গুলিটি বাচ্চার পশ্চাৎদেশ দিয়ে গিয়েছিল এবং এরপর মহিলার বাম বাহুর মধ্য দিয়ে” বলছিলেন ওখানকার চিকিৎসা পরিচালক ডাক্তার আর দত্ত। কিন্তু পুনরায় জ্ঞান ফিরে পেয়ে সে নিজেকে এবং বাচ্চাকে নিয়ে বর্ডারে সরে আসে।

আরেকজন আহত নারী যার পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে গুলিতে ,কোলে বাচ্চাকে নিয়ে দোলাচ্ছিল। সে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সময়ের আগে ই বাচ্চাটিকে জন্ম দেয় এক ধানের ক্ষেতে। তারপরও বাচ্চাটিকে এক হাতে নিয়ে এবং অন্যদের সাথে নিজেকে টেনে নিয়ে এসেছে এই বর্ডারে।
“যদিও আমি জানি এই মানুষগুলোর অবস্থা,আমি অনবরত অবাক হচ্ছি ওদের দৃঢ়তা দেখে” বলছিলেন দত্ত। তারপরও কিছু আছে যারা এখনো মেনে নিতে পারছে না। আমি যেতে যতে দুটো বাচ্চা ছেলেকে মেঝেতে শুয়ে থাকতে দেখেছি, ওরা বানরের মত একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ছিল। “রিফিউজিরা বলল ওদের গ্রাম একসপ্তাহ আগে পুড়ে গেছে এবং সেখানে কেউ বেঁচে নেই শুধু এই দুজন ছাড়া। ওরা আমাদের সাথে আছে ৩দিন ধরে অথচ এখনো আমরা জানি না ওরা কারা। ওরা যে দেখেছে তাতে এতোই ভীত-সন্ত্র্বস্ত যে ওদের বাকশক্তি ফুরিয়ে গেছে। ওদেরকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব এবং খাওয়ানো ও বেশ সময়ের ব্যাপার/ কষ্টসাধ্য। এটা বলা কষ্টকর যে কখন ওরা ওদের ভাষা ফিরে পাবে বা আবার স্বাভাবিক জীবনযাপনের সামর্থ্য ফিরে পাবে”

মেজর জেনারেল এস এস উবান এর দেয়া তথ্য থেকে পাক বাহিনীর ভয়াবহ বীভৎসতার প্রমান পাওয়া যায়,সারা বাংলাদেশে তারা অত্যাচার আর নির্মমতার রোলার চালিয়েছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না এক ফোটাও।
মেজর জেনারেল এস এস উবান
Major General SS Uban: Phantoms of Chittagong

২৬শে মার্চ
হাটখোলা রেললাইনের দু পাড়ের বস্তিতে বাসকারী মানুষগুলো কসাই সেনাবাহিনীর চেহারা দেখার আগেই ভারী মেশিনগানের গুলিতে কচুকাঁটা হয়ে যায়।
পুরান ঢাকার নয়াবাজার বস্তিতে একই রকম হামলা হয়,তবে সেখান থেকে দয়া করে যুবতী ও তরুণী মেয়েদের রেহাই দেয়া হয়,যাদের পরবর্তীতে পালাক্রমে ধর্ষণ করে গনকবর দেয়া হয়।

সিলেট-
সিলেট শহরে জারি করা কারফিউয়ের প্রথম প্রদর্শনী দেখা যায়,কারফিউ সম্পর্কে কোন রকম সতর্ক করা হয়নি সিলেটবাসীকে,কিন্তু রাস্তায় রাস্তায় ব্যরিকেড ও বাঙ্কার বসানো হয়েছিল।
একজন বৃদ্ধ মানুষ বিকেলের দিকে মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে ফিরছেলেন। পাক সেনারা তাকে গুলি করে হত্যা করে,এর পর তার সাথের দুই ছেলেকে আদেশ দেয়া হয় তার লাশ নিয়ে যাবার জন্য। দুজন ছেলে যখন লাশের দিকে এগিয়ে যায়,তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এই তিনটি লাশ এরপর প্রদর্শনীর জন্য রাস্তায় ফেলে রাখা হয়,যাতে সামনে কেউ কারফিউ ভঙ্গ না করে।

এছাড়া সিলেটে এক মসজিদে এক কাতারে নামায আদায়রত একদল মুসল্লিকে মেশিন গানের গুলিতে হত্যা করা হয়। বলা হয় এরা সহিহ বা সত্যিকারের মুসলমান নন,তাই মসজিদে নামাজ আদায়ের অধিকার এদের নেই।

সিলেটের মৌলভিবাজার এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহেই লুট হয়ে যায়,আর শহরের মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। রাতভর ধর্ষনের পর সেখান থেকে নগ্ন অবস্থায় তাদেরকে একটি মাঠে নিয়ে আসা হয়,এবং নাচতে বাধ্য করা হয়,অবাধ্য মেয়েদের গুলি করা হয়। এর পর তাদেরকে শিবপুর আর্মী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়,এই মেয়েদের কোন খোঁজ পরবর্তীতে আর পাওয়া যায়নি।

চট্টগ্রাম-
একইদিনে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে হামলা চালানো হয়,পাক বাহিনীর সাথে ছিল বিহারী মুসলমানেরা। মুহূর্তের মধ্যে হত্যা করা হয় ৩০০০ মানুষকে। ধর্ষণ করা হয় প্রতিটি মেয়েকে। অপেক্ষাকৃত সুন্দরী মেয়েগুলোকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে। বিহারীদের হাতে ছিল রামদা,চাপাতি এবং ড্যাগার।
উদ্ধারকৃত অনেক মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে জানায়,এক সময় পাক সেনাদের ধর্ষণ সহ্য গিয়েছিল,কিন্তু সারা শরীরে আর মুখে ছিটকে পড়া পাক সেনাদের বীর্যর তাপ অসহ্য লাগতো।

৫/৬ এপ্রিলে চট্টগ্রাম একটি পরিত্যক্ত শহরে পরিনত হয়,প্রায় সব বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে,কিছু মেয়েদের হত্যা করা হয়েছে,বাকিরা ক্যাম্পে। নগ্ন ধর্ষিতা মেয়েদের নদীর দিকে মার্চ পাস্ট করানো হয়,সেখানে তাদের হাত পা বেধে গোসল করানো হয়,এবং ক্যাম্পে ফিরিয়ে আনা হয়। প্রতিদিন প্রতিটি মেয়েকে গড়ে ১৫-২০ জন সৈন্য ধর্ষন করেছিল।

১লা এপ্রিল
হোলাটি গ্রাম,সাভার
বীভৎস হৃদয় বিদারক ঘটনার অবতারনা হয় এখানে। পাক সেনারা গ্রাম এই হিন্দু গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে,সাথে ছিল ড্যাগার আর চাপাতি হাতে বিহারীরা। পুরো গ্রামে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়,বাচেনি গরু,ছাগল,কুকুর,বেড়ালও। কিছু মেয়েদের বাচিয়ে রাখা হয় আনন্দের জন্য। মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে দেয়া হয় তাক করা বেয়োনেটের দিকে।

একটি ছয় বছরের বাচ্চা ‘ জয় বাংলা’ স্লোগান বলে ওঠে আপনমনে। এতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয় পাক বাহিনী। পাক বাহিনীর সদস্যরা বাচ্চাটিকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ৫০ টুকরা করে ফেলে। এবং পোড়ানোর আগে গ্রামের হিন্দুদের সেই মাংশের টুকরো খেতে বাধ্য করা হয়।

জে রুমেল
J. Rummel ” Death By Government, p. 329

পাক সেনাবাহিনীর অন্যতম লক্ষ্য ছিল,কিশোর ও যুবকদের বিলুপ্ত করা। তরুন ও যুবকদের যেখানে দেখা গেছে গুলী ছুড়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর লাশগুলো পড়ে ছিল মাঠে,ইটের ভাটায়,আর্মি ক্যাম্পের আশে পাশে। ভেসে উঠেছিল নদীতে,১৫-২৫ বছরের যুবকদের জন্য সময়টা ছিল বিভীষিকাময়। বাড়ির নারীরাও তাদেরকে পালিয়ে যেতে বলেছিলেন। অনেক যুবককে হত্যা করা হয়েছে পালাবার সময়,সীমান্ত এলাকায়। অনেককে ধরে এনেছে বিহারীরা আর্মি ক্যাম্পে।

রবার্ট পেইন
Robert Payne, Massacre [Macmillan, 1973], p. 55

পাক সেনাবাহিনী যে শুধু গনহত্যা চালিয়েছে সেটা বললে ভুল বলা হবে,তারা মৃতদেহের উপর চালিয়েছে পরিক্ষা নিরীক্ষা। বুড়িগঙ্গা নদির পাড়ে যে বদ্ধভুমি আবিষ্কার করা হয়েছে,সেখানে তিনটি আলাদা আলাদা কামরার সন্ধান পাওয়া গেছে,একটি কামরাতে বন্দীদের আটকে রাখা হত,একটি কামরাতে হত্যা করা হত,আর তৃতীয় কামরা থেকে লাশ সরিয়ে ফেলাম ব্যবস্থা করা হত। রাতের পর রাত ধরে মানুষ হত্যা করা হয়েছে,ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে নদী স্রোতে। কিছু কিছু লাশ জায়গা পেয়েছে গনকবরে।
এসব হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল পাকিস্তান সরকার অধিকৃত তেল কোম্পানির ভবনে,গোডাউনে এবং খোলা আকাশের নিচে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে।